চোখের পলকেই যেন একাট বছর কেটে গেলো। আবার ফিরে এলো সেই দিন। ৩ মে। এ দিনটি সংবাদ কর্মী হিসেবে আমার কাছে অনেক আগ্রহের,প্রত্যাশার। কারণ আজ বিশ্ব মুক্ত সাংবাদিকতা দিবস। সংবাদকর্মী হিসেবে একটি প্রত্যাশা ইউনেস্কোর দেখানো পথ ধরেই এ পেশার মানুষের জন্য একসময় সুদিন আসবেই। তবে আজকের দিনটি আমার কাছে বেদনারও। আর ছবি দেখে পরিচিতজনেরা সে বেদনার কারণ জানতে পেরেছেন। এরপরও বলি আজ আমাদের তাজুল ভাইয়ের প্রথম মৃত্যুবার্ষিক। মানে সাংবাদিক ও শিশু সংগঠক তাজুল ইসলাম বাঙালির কথা বলছি । গত বছর এই দিনে তিনি সিলেটের একটি বেসরকারী হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। স্ত্রী আর অবুঝ তিনটি সন্তান রেখে পাড়ি জমান মহান মাবুদের সান্যিধ্যে। সেদিনও ছিলো রমজান মাসের। সেহরী খেয়ে ঘুমালে একটু দেরী হয় উঠতে। আমারও দেরী হয়। ঘুম ভাঙতেই গিন্নি বললেন, কি যেন একটা মাইকের আওয়াজ কানে এলো দূর থেকে। বরইকান্দির তাজুল ভাই মনে হয় নেই। তাজুল ভাইকে তিনি চিনতেন। আমাদের মধ্যে ব্যক্তিগত সম্পর্ক যেমন ছিলো তেমনি পারিবারিক সম্পর্কও ছিলো। একআর আমার স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে বরইকান্দিস্থ বাড়িতে বেড়াতেও গিয়েছিলাম। সে কারণে তাজুল ইসলাম ভাইয়ের বাঙালি শব্দের সনে আমার পরিবারের সবাই পরিচিত। মৃত্যুর আগে কয়েক বছর যেন অসুখ বিসুখ বাসা বেধেছিলো তাজুল ভাইয়ের মাঝে। ডায়াবেটিক রোগী হিসেবেও তিনি ছিলেন স্পর্শকাতর। শেষ ৫/৭বছর আমরা খুব কাছিকাছি না থাকলেও মনের দিক থেকে দূরে ছিলাম না। বিশেষ করে একে অপরের খেঁাজ নিতাম। আমি তাঁকে বাড়িতে দেখতে যেতাম। জালাল ভাইকে পেলেও খেঁাজ নিতাম। জালাল ভাইয়ের (আনন্দ খেলাঘর আসরের সভাপতি) বাড়ি উনার বাড়ির পাশেই । জালাল ভাইয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক তাজুল ভাইয়েরও আগে। জালাল ভাই এবং তার বন্ধু আমিন ভাই, শেখতার ভাই আমাকে খুব স্নেহ করতেন। হঠাৎ ৯৪ সালে আমিন ভাই মারা গেলে জালাল ভাইয়ের জন্য কেন জানি আমার একটা টান বেড়ে যায়। প্রায় সময়েই যোগাযোগ রাখি,খোঁজ নেই। জালাল ভাইকে পেলে প্রথমেই তাজুল ভাইয়ের শারিরিক অবস্থার খেঁাজ খবর নিতাম। এজন্য তাজুল ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদটা পাওয়ার পর পরই দেরী না করে ছুটে যাই। কারণ এই নির্মোহ মানুষটি আমার অনেক আপন ছিলেন। কত আপন আর ভরসার মানুষ ছিলেন সে সম্পর্কে কিছু না বললে বোঝানো যাবেনা।
তখন ২০০৩ সাল। আমি দৈনিক বার্তা বাহকের নিউজ রুমের দায়িত্বে। অফিস উপশহরে। সঙ্গে নবাগত দিপু সিদ্দিকী, নিজামুল হক হামিদীসহ কয়েকজন হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিলাম কাজ করবনা। তখন বিপাকে পড়লাম। আমি না হয়, অন্য পত্রিকায় জয়েন করবো, কির্তু দিপুদের কি হবে?। কারণ দিপুর ছিলো সাংবাকিতার প্রতি প্রবল আগ্রহ। আর আমার সঙ্গেও যেন ওরা এক ভিন্ন মায়ার বাধনে জড়িয়ে গেছে। বার্তা বাহক থেকে তখন আমি সহ কয়েকজন বের হই। দিপু সিদ্দিকী নতুন । তার জন্য তখন আমার অনেক মায়া বেড়ে যায়। এজন্য সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধান্ত নেই নিজের একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলবো। যেখানে ওরা কাজ করবে। কাজ শিখবে। আমারও একটা নিজস্ব প্রতিষ্ঠান হবে, যেটি আমাকেও সাপোর্ট দেবে।অমায়িক ভদ্র শান্ত ছিলো দিপু ও হামিদি। দিপুর হাতের লেখা খুব সুন্দর, গোছানো,ভাষাজ্ঞানও ভালো। তাই মিডিয়াগাইড নামের প্রতিষ্ঠানটি জন্ম দেই সে বছর ৩০ জুন। দিপু সিদ্দিকী ও নিজামুল হক হামিদী নিয়মিত মিডিয়াগাইডে অফিস করে। মান্না চৌধুরী, মেহেদী কাবুল মাঝে মাঝে এসে তাদেরকে সঙ্গ দিত তাদেরকে।। তখন আমি একজন সিনিয়র খেঁাজছিলাম সেখানে বসানোর জন্য। সিলেটে সাংবাদিকতার সুবাধে তখন তাজুল ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় ছিলো। হামিদীরা তাকে গুরু বলে ডাকতো, আসতেন মিডিয়া গাইডেও। হঠাৎ তাদের কাছ থেকেই জানলাম বাঙালি ভাই ‘ফ্রি আছেন”। অর্থাৎ খেলাঘরের তাজুল ইসলাম বাঙালী, তিনি সিআইপিতে নিয়মিত বসতেন। খেলাঘরের মানুষ হিসেবেই যার পরিচিতি ছিল সিলেটের সর্বত্র। আর খেলাঘরই তাকে গড়ে তুলেছিল দক্ষ শিশু সংগঠক হিসেবে। যিনি শিশুদেরকে মানুষ হওয়ার স্বপ্ন দেখাতেন, মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতেন। সর্বোপরি সকল মহলের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক ছিল। তাই উনার মতো একজন বড় ভাইকে পাশে পাবার প্রয়োজন অনুভব করছিলাম। খবর পেলাম কেন জানি তিনি সিআইপিতে তিনি বসছেন না। যোগাযোগ করলাম বাঙালী ভাইয়ের সঙ্গে। উনি বললেন শরীর ভালো যাচ্ছেনা, তাছাড়া রাজা ম্যানশন একটু দূর হয়ে যায়, সব সময় যেতে পারেন না। তাই সিআইপিতে যাচ্ছেন না। আমি বললাম আমার মিডিয়াগাইডতো সুরমা মার্কেটে। আপনিতো এখানে প্রায়ই আসেন। তার পর আলাপচারিতার এক পর্যায়ে রাজী হলেন মিডিয়াগাইডে বসতে। উনি যখন এলেন তখন আমার এখানে তিনটা টেবিল। একটিতে আমি বসি, অন্য দুটিতে দিপু সিদ্দিকী ও নিজামুল হক হামিদি। কোথায় বসতে দেই বড় ভাইকে। তৎক্ষনাৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে আমার চেয়ার ছেড়ে উঠে উনাকে সেখানে বসতে দিলাম। বললাম আপনি এখানেই বসবেন। উনি প্রথমে বলেন এটা কেমনে হয়, তুমি তোমার চেয়ারে থাকো,আমি একখানে বসলেই হলো। সাদামাটা মানুষটার কি সহজ জবাব। তা কি হয়? শেষ মেষ প্রথম দিন থেকে যে ক বছর আমার ওখানে ছিলেন সব সময়েই উনি সেই চেয়ারে বসেছেন কাজ করেছেন। সেসময় অনেক বন্ধু বান্ধব আমার অফিসে এসে দেখতেন ভেতরে আমার চেয়ারে উনি বসা তখন তারা বলতেন এটা ঠিক হয়নি, আর আমি আমারে চেয়ারে যখনই তাজুল ভাইকে দেখতাম তখনআমি আনন্দ পেতাম,সে আনন্দ আজো পাই,উনার মতোমানুষকে আমি যথাযথ মর্যাদা দিতে পেরেছিলাম বলে। কারণ যারা উনার কাছে যাননি,উনার সঙ্গে চলেননি তারা কেউ বলতে পারবেন না কত বিশাল হৃদয়ের মানুষ ছিলেন তাজুল ভাই। তার হৃদয়ের বিশালতার এক নজির সে দিন বললো শিরুল। মানে সিলেটের ছড়ামঞ্চের সভাপতি সিরাজ উদ্দিন শিরুল।
মৃত্যুর কদিন আগে নবীগঞ্জে এক অনুষ্ঠানে শিরুল প্রধান অতিথি জেনেও সেখানে তিনিও আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। যান, বক্তৃতাও দেন গুরুতুল্য তাজুল ভাই। সেখানে তিনি বলেন এখন সময় শিরুলদের, তোমাদের। নিজের চোখে দেখলাম আমার শিরুলরাই আমাদের শুন্যস্থান পূরণ করতে সক্ষম হবে।তাজুল ভাই ছিলেন সাংবাদিক,সংগঠক, ও ক্রিড়ানুরাগী। দেশ সেরা শিশু সংগঠন খেলাঘরের সিলেট জেলা সভাপতি ছিলেন, ছিলেন দক্ষিণ সুরমা প্রেসক্লাবের জ্যেষ্ট সদস্য, জালালাবাদ হাইস্কুলের কমিটির সদস্য ছিলেন,বরই কান্দি আলীম মাদরাসা পরিচালনার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। ছড়ামঞ্চের সভাপতি ছিলেন। শহীদ সুলেমান ও চান মিয়া মেধা বৃত্তি পরীক্ষা পরিচালনার সঙ্গেও স ম্বাংপৃক্লাত ছিলেন তিনি। বাংলাদেশ পোয়েটস ক্লাবকে যে কজন শক্ত ভিত্তির উপর দাড় করিয়ে ছিলেন তার মধ্যে তাজুল ভাই একজন। তাজুল ভাইয়ের সবচেয়ে বড় গুণ ছিলো তিনি শিশুদেরকে আলোর পথ দেখাতেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতেন। ছোট বড় সবাইকে দেশ প্রেমে উদ্ধুদ্ব করতেন,সৎ পরামর্শ দিতেন। আর সততার কারণে তাজুল ভাই ব্যক্তিজীবনে আর্থিক সমৃদ্ধি পাননি, তিনি জোর গলায় বলতেন আমার টাকা নাই, কিন্তু আমার যা আছে বা, তা কজন টাকা ওয়ালার আছে। আর সেটি ছিলো তার সততার স্পষ্ট ধ্বনি।সত্যিকার অর্থেই তাজুল ভাই ছিলেন একজন সৎ নির্ভিক সমাজহিতৈষী,ড় একজন সংগঠক,একজন প্রকৃত নেতা, প্রকৃত মানুষ। বিভিন্ন সময়ে অনেকের মৃত্যুর পর লেখা হয় তিনি অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। কিন্তু বাস্তবে অনেকের ক্ষেত্রে কোনো গুণগ্রাহী পাওয়া যায়নি,ছন্দের সঙ্গেই বাক্য দিয়ে তাল মিলানো হয়। কিন্তু তাজুল ভাইর মৃত্যুর পর সত্যিকার অর্থেই দেখা মিলে গুণগ্রাহীদের। জানাজার নামাজে হাজারো জনতার স্বতস্ফূর্ত উপস্থিতিই জানান দেয় তার কর্মময় জীবনের। আর জনতার চোখের জলকে যদি মাবুদ কবুল করে নেন তবেইতো সফল আমাদের বাঙালী ভাই। যিনি জীবনভর মানুষের জন্য কাজ করেছেন। দেশের জন্য কাজ করেছেন। অন্যর সন্তানদের মঙ্গল চাইতেন। আশা করি শান্তিতে কাটবে তার কবরের জিন্দেগী,সুখে থাকবে তার তিন সন্তান শান্তা, শম্পা ও ইশান বাঙালী । এই কামনাই করি। স্বার্থহীন দেশপ্রেমিক এই প্রিয় মানুষটির প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে জানাই গভীর শ্রদ্ধা। আজ, জানিনা তাজুল ভাই মাটির ঘরে কেমন আছেন। নিশ্চয়ই ভালো। আমাদের কামনাও তাই। গত বছর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আপনার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে মিডিয়াগাইড থেকে কর্মসূচি নেব। কিন্ত আজ যে মুহুর্তে আপনার মৃত্যুবার্ষিক এলো তখন, শুধু আমি নই,গোটা দুনিয়ার মানুষ গৃহবন্দি। কর্মসূচি পা লনের সুযোগ নেই। যদি সে সুযোগ আগামী তে আসে তবে আপনার প্রিয়জনদের জড়ো করার বাসনা রইল। আজ শুধু এটুকু বলি, প্রিয় তাজুল ভাই,ভুলিনি,ভুলবনা ইনশাআল্লাহ। দোয়া করি জান্নাতবাসী হোন।