বিদেশে জয় : দেশে শুরুই হয়নি খালেদার নাইকো মামলার বিচার

30

সবুজ সিলেট ডেস্ক
টেংরাটিলা গ্যাসক্ষেত্রে বিস্ফোরণের ঘটনায় কানাডিয়ান বহুজাতিক তেল-গ্যাস কোম্পানি নাইকোর বিরুদ্ধে করা মামলায় আন্তর্জাতিক আদালতে জয় পেয়েছে বাংলাদেশ। ফলে এক বিলিয়ন ডলারের বেশি ক্ষতিপূরণ পাওয়ার আশা করছে বাংলাদেশ। অপরদিকে নাইকোর সঙ্গে অস্বচ্ছ চুক্তির মাধ্যমে দেশের প্রায় ১৩ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতিসাধন ও দুর্নীতির অভিযোগে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে একই সময়ে করা মামলার বিচার এখনো শুরুই হয়নি। রাষ্ট্রপক্ষ বলছে খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতির জন্য মামলাটির বিচারিক কার্যক্রম এখনো শুরু করা যায়নি। অপরদিকে খালেদা জিয়ার আইনজীবী বলছেন, বেগম খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন কারাগারে ছিলেন। অসুস্থতাজনিত কারণে তাকে আদালতে উপস্থিত করতে পারেনি কারা কর্তৃপক্ষ। এজন্য মামলাটির বিচারিক কার্যক্রম শুরু হয়নি।

দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল জাগো নিউজকে বলেন, দীর্ঘদিন মামলাটি উচ্চ আদালতের আদেশে স্থগিত ছিল। এরপর উচ্চ আদালতের রুল নিষ্পত্তি করে ২০১৭ সালে মামলাটির বিচারিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য আদেশ দেন। একাধিকবার মামলাটির অভিযোগ গঠন শুনানির জন্য দিন ধার্য থাকলেও খালেদা জিয়া আদালতে উপস্থিত হননি। মূলত তার অনুপস্থিতির জন্য মামলাটির বিচারিক কার্যক্রম এখনো শুরু করা যায়নি।

খালেদা জিয়াকে আদালতে উপস্থিত করার দায়িত্ব ছিল কারা কর্তৃপক্ষের। যেহেতু তিনি তখন কাস্টডিতে ছিলেন। অথচ রাষ্ট্রপক্ষ বলছেন তার অনুপস্থিতির জন্য মামলার বিচারিক কার্যক্রম শুরু করা যাচ্ছে না। এই অভিযোগ ঠিক না।

খালেদা জিয়ার আইনজীবী মাসুদ আহম্মেদ তালুকদার বলেন, বেগম খালেদা জিয়া ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে কারাগারে বন্দি ছিলেন। ২০১৯ সালের ১ এপ্রিল থেকে অসুস্থতাজনিত কারণে বন্দি অবস্থায় বিএসএমএমইউতে চিকিৎসাধীন ছিলেন। চলতি বছরের ২৫ মার্চ তাকে ছয় মাসের জন্য মুক্তি দেয় সরকার। এসময় মামলাটির অভিযোগ গঠন শুনানির জন্য একাধিক ধার্য তারিখ ছিল। প্রতি ধার্য তারিখে শুনানির জন্য আদালত বসতো। আমরা শুনানি করতে আদালতে যেতাম। কিন্তু কারা কর্তৃপক্ষ খালেদা জিয়াকে আদালতে উপস্থিত না করে কাস্টডি পাঠাতো। কাস্টডিতে উল্লেখ করা হতো খালেদা জিয়া অসুস্থ। তাই তাকে আদালতে উপস্থিত করা যায়নি।

মাসুদ আহম্মেদ তালুকদার আরো বলেন, খালেদা জিয়াকে আদালতে উপস্থিত করার দায়িত্ব ছিল কারা কর্তৃপক্ষের। যেহেতু তিনি তখন কারা কর্তৃপক্ষের কাস্টডিতে ছিলেন। অথচ রাষ্ট্রপক্ষ বলছে, খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতির জন্য মামলার বিচারিক কার্যক্রম শুরু করা যাচ্ছে না। রাষ্ট্রপক্ষের এই অভিযোগ ঠিক নয়।

নাইকোর বিরুদ্ধে মামলায় বাংলাদেশের জয়

টেংরাটিলা গ্যাসক্ষেত্রে বিস্ফোরণের ঘটনায় কানাডিয়ান বহুজাতিক তেল-গ্যাস কোম্পানি নাইকোর বিরুদ্ধে করা মামলায় আন্তর্জাতিক আদালতে জয় পেয়েছে বাংলাদেশ। দীর্ঘ দশ বছর আইনি লড়াইয়ের পর এ বিষয়ে দেওয়া রায়ে নাইকোকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে বিনিয়োগ বিরোধ নিষ্পত্তি সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আদালত (ইকসিড)।

গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ইকসিড বাংলাদেশের পক্ষে এই রায় প্রদান করে। এর ফলে এক বিলিয়ন ডলারের বেশি ক্ষতিপূরণ পাওয়ার আশা করা হচ্ছে বলে মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। ক্ষতির বিষয়টি চূড়ান্ত করতে আগামী সেপ্টেম্বরে আবার শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে।

রোববার (৩ মে) বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ এক অনলাইন সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ২০১৬ সালের ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান দিয়ে যে ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করা হয় তা ২০১৮ সালে ইকসিডে জমা দেয়া হয়েছে। ইকসিড রায়ে বলেছে নাইকোর গাফিলতি এবং অদক্ষতার জন্যই বিস্ফোরণ ঘটেছে। ফলে এর দায় নাইকোকেই নিতে হবে। বাংলাদেশকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। ক্ষতির বিষয়টি চূড়ান্ত করতে আগামী সেপ্টেম্বরে আবার শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে। সবমিলিয়ে এক বিলিয়ন ডলারের বেশি ক্ষতিপূরণ পাওয়ার আশা করা হচ্ছে বলেও মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।

সরকার টেংরাটিলা, ফেনী ও কামতা গ্যাসক্ষেত্রকে ‘প্রান্তিক’ (যে ক্ষেত্র থেকে বাণিজ্যিকভাবে গ্যাস উত্তোলনের সম্ভাবনা শেষ হয়ে গেছে) দেখিয়ে সেখান থেকে গ্যাস তোলার জন্য ১৯৯৯ সালে নাইকো-বাপেক্স যৌথ উদ্যোগের সঙ্গে চুক্তি করে।

ওই চুক্তির অধীনে নাইকোর অদক্ষ কূপ খনন প্রক্রিয়ার কারণে ২০০৫ সালে দু’বার (৭ জানুয়ারি ও ২৪ জুন) সুনামগঞ্জের টেংরাটিলা গ্যাসক্ষেত্রে বিস্ফোরণ ঘটে। দুর্ঘটনার কারণে মজুত গ্যাস পুড়ে যায়। আশপাশের সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি হয়। এজন্য নাইকোর কাছে ৭৪৬ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করে পেট্রোবাংলা, যা দিতে অস্বীকৃতি জানায় প্রতিষ্ঠানটি। ক্ষতিপূরণ আদায়ে পেট্রোবাংলা নাইকোর বিরুদ্ধে ২০০৭ সালে স্থানীয় নিম্ন আদালতে মামলা করে।

খালেদার নাইকো মামলা

সেনা নিয়ন্ত্রিত সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় খালেদা জিয়া গ্রেফতার হওয়ার পর ২০০৭ সালের ৯ ডিসেম্বরে রাজধানীর তেজগাঁও থানায় এ মামলা করে দুদক। পরের বছরের ৫ মে খালেদাসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। এতে বলা হয়েছে, ক্ষমতার অপব্যবহার করে তিনটি গ্যাসক্ষেত্র পরিত্যাক্ত দেখিয়ে কানাডার কোম্পানি নাইকোর হাতে ‘তুলে দেওয়ার’ মাধ্যমে আসামিরা রাষ্ট্রের প্রায় ১৩ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকার ক্ষতি করেছেন।

মামলার পর খালেদা জিয়া উচ্চ আদালতে গেলে ২০০৮ সালের ৯ জুলাই দুর্নীতির এ মামলার কার্যক্রম স্থগিত করেন হাইকোর্ট, সেই সঙ্গে রুলও জারি করা হয়। প্রায় সাত বছর পর গত বছরের শুরুতে রুল নিষ্পত্তির মাধ্যমে মামলাটি সচল করার উদ্যোগ নেয় দুদক।

রুলের শুনানি শেষে ২০১৫ সালের ১৮ জুন খালেদার আবেদন খারিজ করে মামলার ওপর থেকে স্থগিতাদেশ তুলে নেন হাইকোর্ট। ওই রায়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেওয়া হয়। সে অনুসারে ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর জজ আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন পান খালেদা।

এরপর হাইকোর্টের দেওয়া আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করেন খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা। ২০১৭ সালের ৭ মার্চ বিচারপতি শেখ আবদুল আউয়াল ও বিচারপতি মো. খসরুজ্জামানের হাইকোর্ট বেঞ্চ রুলসহ এ মামলার কার্যক্রমের ওপর স্থগিতাদেশ দেন। একই বছর ১৬ মার্চ হাইকোর্টের দেওয়া আদেশ স্থগিত চেয়ে দুদকের করা আবেদন এক সপ্তাহের জন্য স্ট্যান্ডওভার করেছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।

২০১৭ সালের ২৩ মার্চ বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে নাইকো দুর্নীতির অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়ের করা মামলার কার্যক্রমের ওপর হাইকোর্টের জারি করা রুল খারিজ করে দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। যার ফলে বিচারিক আদালতে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে নাইকো মামলা চলতে আর কোনো বাধা নেই।

মামলার অন্যতম আসামি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের পক্ষেও মামলাটি স্থগিত ছিল।২০১৭ সারের ১২ এপ্রিল বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের বিরুদ্ধে নাইকো দুর্নীতি মামলার কার্যক্রম স্থগিত করে জারি করা রুল খারিজ করে দেন হাইকোর্ট।

মামলার অন্য আসামিরা হলেন-বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ, সাবেক জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী এ কে এম মোশাররফ হোসেন, তখনকার প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সচিব খন্দকার শহীদুল ইসলাম, সাবেক সিনিয়র সহকারী সচিব সি এম ইউছুফ হোসাইন, বাপেক্সের সাবেক মহাব্যবস্থাপক মীর ময়নুল হক, বাপেক্সের সাবেক সচিব মো. শফিউর রহমান, ব্যবসায়ী গিয়াস উদ্দিন আল মামুন, ঢাকা ক্লাবের সাবেক সভাপতি সেলিম ভূঁইয়া (সিলভার সেলিম) এবং নাইকোর দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট।

খালেদা জিয়াসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে নাইকো দুর্নীতি মামলাটি ঢাকার ৯ নম্বর বিশেষ আদালতে বিচারাধীন অবস্থায় রয়েছে। কেরানীগঞ্জের কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে নবনির্মিত ২ নম্বর ভবনে স্থাপিত অস্থায়ী আদালতে বিচারিক কার্যক্রম চলছে। সর্বশেষ গত ৪ ফেব্রুয়ারি মামলাটির অভিযোগ গঠন শুনানির জন্য দিন ধার্য ছিল। কিন্তু খালেদা জিয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) চিকিৎসাধীন থাকায় তাকে আদালতে হাজির করা হয়নি। এ জন্য রাষ্ট্রপক্ষ সময়ের আবেদন করেন। আদালত সময়ের আবেদন মঞ্জুর করে ৩১ মার্চ মামলাটির অভিযোগ গঠন শুনানির জন্য দিন ধার্য করেন। কিন্তু এদিন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে আদালত বন্ধ থাকায় মামলাটির শুনানি হয়নি। আদালত চালু হলে অভিযোগ গঠন শুনানির জন্য মামলাটির নতুন দিন ধার্য করা হবে বলে আদালত সূত্রে জানা গেছে।

উল্লেখ্য, দুর্নীতি মামলায় কারাদণ্ড দিয়ে খালেদা জিয়াকে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডে অবস্থিত পুরোনো কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি রাখা হয়েছিল। চলতি বছরের ২৫ মার্চ খালেদা ৭৭৫ দিন কারাভোগের পর খালেদা জিয়াকে ছয় মাসের জন্য মুক্তি দিয়েছে সরকার। বর্তমানে তিনি তার গুলশানের বাসভবন ফিরোজায় রয়েছেন।