সবুজ সিলেট ডেস্ক
চট্টগ্রামে নভেল করোনাভাইরাসে (কোভিড-১৯) আক্রান্তদের ৯৫ ভাগই ম্যালেরিয়ার ওষুধ প্রয়োগে সুস্থ হচ্ছেন। চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল এবং ফৌজদারহাটে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেজে (বিআইটিআইডি) চলছে করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসা। দুই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় কারও মৃত্যু হয়নি। বরং চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন ২৪ জন।
চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, চট্টগ্রামে এ পর্যন্ত আট জনের মৃত্যু হয়েছে। চিকিৎসা শুরুর আগেই তাদের মৃত্যু হয়েছে। সঠিক চিকিৎসা দিতে পারলে তাদের প্রাণে বাঁচানো যেত বলে মনে করেন তারা। চট্টগ্রামের মতো সারাদেশেই কোভিড-১৯ রোগীদের জন্য এই চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে বলেও জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা।
চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জনের কার্যালয়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ৩ এপ্রিল চট্টগ্রামে প্রথম কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত একজন শনাক্ত হন। এরপর থেকে মঙ্গলবার (৫ মে) পর্যন্ত চট্টগ্রামে কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন ১১০ জন। এদের মধ্যে সুস্থ হয়েছেন ২৪ জন, মারা গেছেন আট জন। আক্রান্ত হয়ে ও করোনার উপসর্গ আছে— এমন ১৪৯ জন হাসপাতালে আইসোলেশনে আছেন। সুস্থ হওয়া রোগীদের মধ্যে ২১ জন চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে এবং তিন জন বিআইটিআইডিতে চিকিৎসা নিয়েছেন।
সূত্রমতে, চট্টগ্রামে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত যে আট জনের মৃত্যু হয়েছে তার মধ্যে ছিল পটিয়ার এক শিশু। শনাক্তের পর জেনারেল হাসপাতালে আনার ২০ মিনিটের মধ্যেই সে মারা যায়। শনাক্ত হওয়ার পর আরেক বৃদ্ধকেও জেনারেল হাসপাতালে নেওয়ার পথেই তার মৃত্যু হয়। বাকিদের বেশিরভাগেরই নমুনা শনাক্তের আগেই মৃত্যু হয়েছে।
চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র কনসালট্যান্ট ও ফোকাল পারসন ডা. মো. আব্দুর রব জানান, চার ধাপে কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। প্রথমে শরীরের উপসর্গ বিবেচনায় নিয়ে ওষুধ দেওয়া হচ্ছে। জ্বর থাকলে প্যারাসিটামল, কাশি-শ্বাসকষ্ট থাকলে ইনহেলার-অক্সিজেন সাপোর্ট দেওয়া হচ্ছে।
দ্বিতীয়ত, ৫০০ মিলিগ্রামের এজিথ্রোমাইসিন গ্রুপের অ্যান্টিবায়োটিক প্রথম দিন একটি দেওয়া হচ্ছে। এরপর দ্বিতীয় থেকে পঞ্চম দিন পর্যন্ত ২৫০ মিলিগ্রাম করে দিনে তিন বার দেওয়া হচ্ছে।
তৃতীয়ত, আক্রান্ত হিসেবে শনাক্তের পর হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন দিয়ে শুরু হচ্ছে ১০ দিনের মূল চিকিৎসা। প্রথম দিন দুইটি করে সকালে ও রাতে দুই বার দেওয়া হচ্ছে। বাকি ৯ দিন একটি করে দিনে তিন বার।
আবার যাদের শ্বাসকষ্ট বেশি এবং রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা ৯৩ শতাংশের নিচে নেমে যায়, তাদের অক্সিজেন দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে আবার বেশি জটিল রোগীদের নেওয়া হচ্ছে আইসিইউতে, আর হৃদরোগের জন্য ব্যবহৃত এনোক্সাপেরিন ইনজেকশন দেওয়া হচ্ছে নাভির নিচে দিনে একটি করে মোট পাঁচ দিন।
আব্দুর রব বলেন, ‘করোনার চিকিৎসার জন্য যেহেতু এখনো শতভাগ সুনির্দিষ্ট কোনো পদ্ধতি পাওয়া যায়নি, আমরা স্বাস্থ্য অধিদফতরের গাইডলাইন মেনে সমন্বিত একটি পদ্ধতি ফলো করছি। অ্যান্টিবায়োটিক দিচ্ছি, হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন দিচ্ছি এবং অক্সিজেন ও আইসিইউ সাপোর্টসহ এনোক্সাপেরিন ইনজেকশন ব্যবহার করছি।
চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের এই সিনিয়র কনসালট্যান্ট বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগের পরই অনেকের শরীরে আর তেমন উপসর্গ দেখা যাচ্ছে না। হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন দেওয়ার পর পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাচ্ছে। আমাদের গত একমাসে মাত্র পাঁচ জন রোগীকে আইসিইউ সাপোর্ট দিতে হয়েছে। এনোক্সাপেরিন ইনজেকশন প্রয়োগের পর তারা সুস্থ হয়েছেন। এখন কেউ পর্যন্ত কাউকে ভেন্টিলেটারি সাপোর্ট দেওয়ার প্রয়োজন হয়নি।’
তিনি আরও বলেন, আমরা এখানে অধিদফতরের নির্দেশনা অনুযায়ী এই ওষুধগুলো ব্যবহার করেছি। তবে এটিই যে করোনাভাইরাসের চিকিৎসায় গ্রহণযোগ্য ওষুধ ও মাত্রা, সেটি নয়। কারণ এর আগে আমরা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে দেখেছি, আমেরিকায় এ ধরনের ওষুধ ব্যবহারে রোগীর শারীরিক অবস্থার অবনতিও ঘটেছে। ফলে আমাদের এখানে কোভিড-১৯ চিকিৎসায় করণীয় হলো স্বাস্থ্য অধিদফতরের যে গাইডলাইন, সেটি অনুসরণ করা।
বিআইটিআইডি’র পরিচালক অধ্যাপক ডা. এম এ হাসান চৌধুরী বলেন, ‘করোনায় আক্রান্তদের ক্ষেত্রে আমরা কিছু বিষয়কে খুবই গুরুত্ব দিচ্ছি। প্রিভিয়াস হিস্ট্রি, শরীরে অন্য কোনো রোগের লক্ষণ আছে কি না, হৃদরোগ বা কিডনি জটিলতায় ভুগছেন কি না এবং আক্রান্ত হওয়ার আগে-পরে কী উপসর্গ দেখা যাচ্ছে— এই বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে চিকিৎসা দিচ্ছি। এর মধ্যে অ্যান্টিবোয়োটিক ও হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন ওষুধ ব্যবহার করে ৯৫ ভাগ রোগীকেই আমরা সুস্থ করে ফেলতে পারছি। বাকি পাঁচ শতাংশ রোগীর জটিলতা একটু বেশি। শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা নির্দিষ্ট লেভেলের নিচে নেমে গেলে তখন অন্য সাপোর্ট লাগছে, সেক্ষত্রে হয়তো দুয়েকটি দুর্ঘটনা ঘটছে।’
দেশে এখন ম্যালেরিয়া প্রায় নির্মূলের পথে। বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের গবেষণায় বলা হয়েছে, গত এক দশকে দেশে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা কমেছে প্রায় ৮৭ শতাংশ।
ব্র্যাকের ম্যালেরিয়া নির্মূল কর্মসূচির প্রধান ডা. শায়লা ইসলাম বলেন, ‘দেশে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত ও মৃত্যু একেবারেই কমে গেছে। গত বছর (২০১৯) ১৭ হাজারের মতো শনাক্ত হয়েছিল। এ বছরের গত চার মাসের প্রত্যেক মাসে আক্রান্তের সংখ্যা একশরও কম। গতবছর মৃত্যু হয়েছিল ৯ জনের। গত চার মাসে মারা গেছেন মাত্র একজন, ফেনীর ফুলগাজী এলাকায়।’
তিনি বলেন, দেশের তিন পার্বত্য জেলা বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়িতে এখনো ম্যালেরিয়ার প্রকোপ বেশি। সেখানে জুম চাষিরা মশার কামড়ে আক্রান্ত হন। সঠিক সময়ে তাদের কাছে ওষুধ পৌঁছানো যায় না, সেজন্য সেখানে পুরোপুরি নির্মূল করা যায়নি। এই তিনটি জেলাসহ চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ ও সিলেটের ১৩টি জেলায় এখনো ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব কিছুটা অবশিষ্ট আছে।’
মশা নিধন নয়, সঠিক সময়ে সঠিক ওষুধ মানুষের মধ্যে পৌঁছে দিতে পারার কারণেই ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণে এই সাফল্য এসেছে বলে মনে করছেন ডা. শায়লা ইসলাম। একই ওষুধ প্রয়োগ করে করোনায় আক্রান্তদের সুস্থ করে তোলাকেও ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন তিনি।
তবে করোনায় আক্রান্তদের ম্যালেরিয়ার ওষুধ প্রয়োগের ফলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার আশঙ্কাও তৈরি হচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. অনিরুদ্ধ ঘোষ বলেন, ‘করোনাভাইরাস শরীরে প্রবেশের পর রি-প্রোডাকশন রোধ করছে ম্যালেরিয়ার ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন। স্বাস্থ্য অধিদফতর গত এপ্রিলেই ওষুধটি ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে। জাতীয় চিকিৎসা নির্দেশিকা মেনেই ওষুধটি প্রয়োগ করা হচ্ছে। যেকোনো ওষুধেরই কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে। স্বাভাবিকভাবে এই ওষুধেরও থাকবে। এসএলই রোগ প্রতিরোধে বিশ্বজুড়ে এটা মাসের পর মাস খাওয়ানো হয়। আমাদের এখানে দেওয়া হচ্ছে মাত্র ১০ দিন। সুতরাং আমাদের এখানে প্রতিক্রিয়া তেমনভাবে হওয়ার আশঙ্কা নেই। কয়েকদিন হয়তো খাওয়ার রুচি থাকবে না বা সামান্য কিছু অস্বস্তি থাকতে পারে। কিন্তু সেটা দীর্ঘমেয়াদি এবং বড় কোনো ক্ষতির কারণ হবে না।’
চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে গত ৩ মে সুস্থ হয়ে ফিরেছেন সিএমপির ট্রাফিক বিভাগের কর্মরত পুলিশ কনস্টেবল অরুণ চাকমা। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘ডাক্তারের পরামর্শমতো ম্যালেরিয়ার ওষুধ আমি খেয়েছি। সুস্থ হওয়ার পর আমার শুধুমাত্র খাওয়ার রুচি একটু কম। জ্বর হলে যেমন খাওয়ার রুচি চলে যায়, সেরকমই। অন্য কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। ডাক্তারের পরামর্শে আমি এখন শুধু ভিটামিন খাচ্ছি।’
এ অবস্থায় নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) চিকিৎসায় যুক্তরাষ্ট্রে অনুমোদিত অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ ‘রেমডেসিভির’ দেশে উৎপাদনের অনুমতি পেয়েছে ছয় ওষুধ কোম্পানি। এর মধ্যে দুইটি কোম্পানি জানিয়েছে, তারা আগামী ২০ মে’র মধ্যেই উৎপাদনের প্রক্রিয়া শেষ করতে পারবে।
রেমডেসিভির বাজারে এলে ম্যালেরিয়ার ওষুধ প্রয়োগের প্রয়োজন হবে কি না, জানতে চাইলে অধ্যাপক অনিরুদ্ধ ঘোষ বলেন, ‘দুই ওষুধের কাজ দুই ধরনের। এ ব্যাপারে নিশ্চয় স্বাস্থ্য অধিদফতর গাইডলাইন দেবে। তবে রেমডেসিভির ওষুধ প্রয়োগ সফল হলে হয়তো আর হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইনের প্রয়োজন না-ও হতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিতে দেখা যাচ্ছে, কোভিড-১৯-এ আক্রান্তদের মধ্যে ২০ শতাংশের কোনো উপসর্গ থাকছে না। তারা আশঙ্কামুক্ত ধরে নেওয়া যায়। ৬০ শতাংশের কাশি-শ্বাসকষ্টসহ সামান্য উপসর্গ থাকছে, যেটা বিদ্যমান চিকিৎসায় নিরাময়যোগ্য। ১৪ শতাংশের মডারেট ইম্প্রুভমেন্ট হচ্ছে। বাকি ৬ শতাংশ আছে, তাদের মধ্যে আবার অন্তত দুই শতাংশকে সুস্থ করা সম্ভব। সঠিক সময়ে শনাক্ত হলে বিদ্যমান চিকিৎসা পদ্ধতি প্রয়োগ করে যদি শরীরে করোনাভাইরাসের রি-প্রোডাকশন ঠেকানো যায়, তাহলে মৃত্যুঝুঁকি একেবারেই কমে যাবে।’
চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র কনসালট্যান্ট ডা. আব্দুর রব সারাবাংলাকে বলেন, ‘হাসপাতালে আক্রান্ত হিসেবে যারা ভর্তি হচ্ছেন, তাদের অর্ধেকেরও বেশি রোগীর কিন্তু বাসায় থেকেই সুস্থ হওয়া সম্ভব। শুধু কিছু গাইডলাইন ফলো করলেই তারা সুস্থ হয়ে যাবেন। কিন্তু যেহেতু আমাদের দেশে সামাজিক প্রতিবন্ধকতা বেশি এবং মানুষ সেভাবে সচেতন নয়, তাই হাসপাতালে আসতে হচ্ছে।’
তবে কোভিড-১৯ চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের প্রত্যেকেই এটি স্পষ্ট করে বলছেন, রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া বাসায় নিজে নিজে কোনো ওষুধ গ্রহণ করা যাবে না। করোনাভাইরাসের উপসর্গ দেখা দিলে অবশ্যই কোভিড-১৯ হেল্পলাইনগুলোতে যোগাযোগ করে পরামর্শ নিতে হবে। সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা যেভাবে নির্দেশনা দেবেন, সেভাবে নিয়ম মেনে চলতে হবে এবং ওষুধ গ্রহণ করতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মঙ্গলবারের সবশেষ তথ্য বলছে, সারাদেশে এ পর্যন্ত ১০ হাজার ৯২৯ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন। এর মধ্যে শনাক্ত হয়েছেন ৭৮৬ জন, যা একদিনের হিসাবে সর্বোচ্চ। আক্রান্তদের মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় আরও একজনের মৃত্যু হয়েছে। সব মিলিয়ে মারা গেছেন ১৮৩ জন। আর গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ১৯৩ জন সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে গেছেন। এ নিয়ে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মোট ১ হাজার ৪০৩ জন সুস্থ হলেন।