সবুজ সিলেট ডেস্ক
বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশ কাতারে কর্মরত নিম্ন আয়ের অভিবাসী শ্রমিকেরা জানিয়েছেন খাবারের জন্য তাদের রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা করতে হচ্ছে। বাংলাদেশিসহ ২০ জনেরও বেশি প্রবাসী শ্রমিকের সঙ্গে আলাপ করে এই খবর জানিয়েছে গার্ডিয়ান। এদের অনেকেই ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমটি জানিয়েছেন, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে তারা হঠাৎ করেই কর্মহীন হয়ে পড়েছেন, জীবন ধারণের অন্য কোনও উপায়ও তাদের নেই। আবার অনেকেই দেশে ফেরার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলেও সে সুযোগও পাচ্ছেন না। আবার অনেকেই নিয়োগদাতা কিংবা দাতব্য সংস্থাগুলোর কাছে খাবার ভিক্ষা চাইছেন।
কাতারে প্রায় ২০ লাখ বিদেশি শ্রমিকের কাজ করে। মাত্র ২৮ লাখ জনসংখ্যার এই দেশটিতে গত কয়েক দিনে প্রায় ১৮ হাজার মানুষের করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। গত সপ্তাহে পরীক্ষা করা ২৫ শতাংশের বেশি নমুনায় পজিটিভ ফলাফল এসেছে। আক্রান্তদের বেশিরভাগই প্রবাসী শ্রমিক। কাতার সরকারের দাবি বেশিরভাগ সংক্রমনই হাল্কা ধরনের। ফলে দেশটিতে মৃতের সংখ্যা কম। এখন পর্যন্ত দেশটিতে মাত্র ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি তাদের।
করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরুর পর গত মার্চে কাতারে কর্মহীন হয়ে পড়েন বাংলাদেশি ক্লিনার রফিক। তিনি গার্ডিয়ানকে বলেন, ‘আমার কাছে আর বেশি খাবার নেই। অল্প কিছু চাল আর ডাল আছে। এতে আর কয়েক দিন হয়তো যাবে। এই খাবার শেষ হয়ে গেলে কী হবে?’
করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে আরোপিত বিধি নিষেধের কারণে এপ্রিলের মাঝামাঝিতে অনেক কোম্পানির কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। ওই সময়ে দেওয়া সরকারি নির্দেশনার কারণে অনেক কোম্পানি শ্রমিকদের বিনা বেতনে ছুটি দিতে কিংবা চুক্তি বাতিল করে দেয়। সরকারি নির্দেশনায় এসব কর্মীদের খাবার ও বাসস্থানের নিশ্চয়তা চালিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়। সাধারণত নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এসব সরবরাহ করে থাকে। তবে শ্রমিকেরা বলছেন, অনেক ক্ষেত্রেই তা হয়নি।
ফিলিপাইনের এক বিউটিশিয়ান জানান মাত্র দুই মাস আগে তিনি কাতারে এসেছেন। মাত্র অর্ধেক মাসের বেতন পাওয়ার পর তাছে ছাঁটাই করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমার মালিক বলেছেন টাকা নেই। ফিলিপাইনে আমার পরিবারের কী হবে? তাদের টাকার দরকার… আমি কিভাবে খাবার কিনবো? দেওয়ার কেউ নাই। এমনকি আমার মালিকও (খাবার) দিচ্ছে না।’
সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থদের মধ্যে রয়েছেন অনিবন্ধিত শ্রমিকেরা। এসব শ্রমিকদের প্রায়ই ‘ফ্রি ভিসা’র শ্রমিক বলা হয়। তারা স্বল্প মেয়াদী বা অনিয়মিত কাজ করে থাকে। তাদের নিয়মিত নিয়োগকর্তাও থাকে না যারা খাবার বা আবাসনের ব্যবস্থা করবে।
ফ্রি ভিসায় কাতারে কাজ করেন বাংলাদেশি ডেকোরেটর সাইদুল। মার্চের মাঝামাঝি থেকে তিনি কর্মহীন হয়ে আছেন। তিনি বলেন, ‘আমার জমানো সব টাকা শেষ। খাবার ও ভাড়ার জন্য বন্ধু ও আত্মীয়দের কাছ থেকে ধার করেছি। কাজ ছাড়া টিকে থাকা খুবই কঠিন… করোনা নিয়ে ভয় নেই। সমস্যা হলো কাজ নেই।’
মারাত্মক অসহায় অবস্থায় পড়েছেন গৃহকর্মীরাও। নেপালের এক দল গৃহকর্মী দিনের বেলায় কাতারের বিভিন্ন বাড়িতে কাজ করে রাতে নিজেদের ঘরে আশ্রয় নিতো। এসব শ্রমিকদের অনেকেই গার্ডিয়ানকে বলেছেন, করোনাভাইরাসের শঙ্কায় কাজে যেতে অস্বীকৃতি জানানোর পর তারা পরিত্যক্ত হয়ে পড়েছেন।
এক নারী গৃহকর্মী জানান, যে কোম্পানির মাধ্যমে তারা নিয়োগ পেয়েছিলেন তারা একটি কাগজে স্বাক্ষর নিয়ে রেখেছে। এতে বলা হয়েছে তাদের বেতন নিয়ে আর কোনও বাধ্যবাধকতা নেই তাদের। মার্চের শুরুতে তাদের প্রত্যেককে একশো রিয়াল করে দেওয়া হয়। এক কর্মী বলেন, ‘আমাদের কাছে আর কোনও অর্থ নেই। সুপারভাইজারের কাছে খাবার চেয়েছিলাম তিনি সামান্য কিছু দিয়েছেন। কিন্তু এগুলো শেষ হয়ে গেলে কী হবে?’
গত বুধবার শিল্প এলাকার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা শিথিলের ঘোষণা দেয় কাতার সরকার। রাজধানী দোহার বাইরে এই শিল্প এলাকাতে বিভিন্ন কারখানা ও শ্রমিক ক্যাম্প রয়েছে। ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর এসব এলাকা মার্চের শুরু থেকেই কঠোর লকডাউনের অধীনে ছিলো।
কোয়ারেন্টিনে কিংবা আইসোলেশনে থাকা শ্রমিকদের মজুরি নিশ্চিত করতে কাতার সরকার ৬৫ কোটি ৬০ লাখ ডলারের একটি প্রকল্প প্রতিষ্ঠা করেছে। তবে শিল্প এলাকার অনেক শ্রমিক বলছেন, তাদের বিনা বেতনের ছুটিতে পাঠানো হয়েছে।
দুই মাস ধরে শিল্প এলাকায় আটকা পড়ে রয়েছেন ভারতের শ্রমিক ফিরোজ। তিনি বলেন, ‘কোম্পানি বলেছে আমাদের এপ্রিলের বেতন দেবে না কিন্তু খাবারের জন্য কিছু দেওয়া হবে… সেগুলোও পাইনি। কয়েক দিন আগে কিছু ডিম আর একটু তেল দিয়েছিলো। সেটাই শেষ।’
(পরিচয় আড়াল করতে শ্রমিকদের নাম পরিবর্তন করেছে গার্ডিয়ান)