করোনাভাইরাস সঙ্কটের এই সময়ে কিডনির জটিলতায় অসুস্থ অতিরিক্ত সচিব গৌতম আইচ সরকারকে নিয়ে একের পর এক হাসপাতাল ঘুরতে হল তার পরিবারকে।
অন্য কোনো হাসপাতালে না পেরে শেষে বৃহস্পতিবার কোভিড-১৯ রোগীদের জন্য নির্দিষ্ট কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল এই সরকারি কর্মকর্তাকে।
শনিবার বেলা ১২টার দিকে গৌতম আইচের মৃত্যু হয় বলে তার মেয়ে সুস্মিতা আইচ জানিয়েছেন, যিনি নিজেও একজন চিকিৎসক।
সুস্মিতা বলেন, “কোভিড-১৯ এর কোনো উপসর্গ না থাকলেও অন্য কোনো উপায় না পেয়ে অনেক কষ্টে বাবাকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করাই।
“বাবার আইসিইউ সাপোর্টটা খুব দরকার ছিল, কিন্তু তা পাওয়া যায়নি। বাবার চিকিৎসাই হল না, তিনি মারা গেলেন। আমি ডাক্তার হয়েও কিছু করতে পারলাম না।”
যে ৩৩৩ হটলাইন নম্বর থেকে সরকার স্বাস্থ্য সেবা দিচ্ছে, সেখানে দায়িত্ব পালন করছেন ডা. সুম্মিতা।
বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে তাকে কুর্মিটোলা হাসপাতালে ভর্তি করা হলেও তার বাবা কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত কি না, তা জানার চেষ্টাও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ করেনি।
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের অন্য রোগীদের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হতে যে ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে, অতিরিক্ত সচিব গৌতম আইচের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। তার চিকিৎসক মেয়েও হাসপাতালগুলোর কর্তৃপক্ষদের বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছেন যে শ্বাসকষ্ট থাকলেও তার বাবা কোভিড-১৯ রোগী নন, আর তিনি তার বাবার রোগের আদ্যোপান্তই জানেন।
গৌতম আইচ দীর্ঘ দিন ধরে কিডনির নানা জটিলতায় ভুগছিলেন বলে তার স্বজনরা জানিয়েছেন।
সুস্মিতা বলেন, “বাবার কিডনির সমস্যা ছিল, নিয়মিত ডায়ালাইসিস পেত। ডায়ালাইসিসের সময় প্রায়ই হঠাৎ করে প্রেসার বেড়ে যেত, শ্বাসকষ্ট হত, লাংসে পানি চলে আসত। আইসিইউ সাপোর্ট হলে ঠিকও হয়ে যেত।”
গত বৃহস্পতিবার ল্যাবএইড হাসপাতালে অতিরিক্ত সচিব গৌতমের ডায়ালাইসিসের সময় প্রেসার বাড়ার পাশাপাশি শ্বাসকষ্ট শুরু হলে ল্যাবএইডের ইমার্জেন্সি থেকে চিকিৎসক মেয়ে সুস্মিতাকে ফোন করা হয়।
“আমি বাবাকে ল্যাবএইডে ভর্তি করাতে বলি। তখন তারা বলে, তাদের কনসালটেন্ট নেই, ভর্তি রাখতে পারবে না। তারা জানায়, ল্যাবএইডে তারা আইসিইউ সাপোর্ট দিতে পারবে না। তাই প্রেসার কমানোর ওষুধ দিয়ে বাসায় নিয়ে যেতে বলে। ল্যাবএইডে তিনি নিয়মিত যে ডাক্তারকে দেখান তিনিও সেদিন ছুটিতে ছিলেন।
“আমার কাছে মনে হয়েছে বাসায় আনা ঠিক হবে না, এই মুহূর্তে অক্সিজেন দরকার। বিকাল ৪টায় ডায়ালাইসিস শেষ হয়, আমরা বাবাকে নিয়ে বিকাল ৫টার দিকে ইউনাইটেড হাসপাতালে যাই। তাদের কথা, শ্বাসকষ্ট যেহেতু হচ্ছে, কোভিড-১৯ কি না?
“তার কোনো জ্বর ছিল না। আমি নিজে ডাক্তার পরিচয় নিয়ে সব কিছু বুঝিয়ে বললাম। তখন তারা বলল, কোনো রেফারেন্স ছাড়া তারা ভর্তি নিতে পারবে না। সেখানে আমরা কোভিড-১৯ টেস্ট করাতে চাইলে তারা আইইডিসিআরের কথা বলে। কিন্তু তারা আইইডিসিআর) তো টেস্ট করানো বন্ধ করে দিয়েছে!”
পরে গৌতমকে নিয়ে মহাখালীর ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান তার মেয়ে।
সুস্মিতা বলেন, “তারাও টেস্ট করানোর কথা বলে স্কয়ারে নেওয়ার পরামর্শ দেন। সেখান থেকে আনোয়ার খান মর্ডান হাসপাতালে নিয়ে আসি, কিন্তু তারা পেশেন্টকে দেখেইনি, চেকও করেনি। তারা বলে, ভর্তি নিতে পারবে না। যেহেতু আমি এই হাসপাতালে কাজ করেছি, আমি অতিরিক্ত পরিচালকের সঙ্গে কথা বলি। তিনি চেস্ট এক্সরে করিয়ে আনতে বলেন। কিন্তু আমার ভয় হচ্ছিল বাবা স্ট্রোক করেছে। কারণ তার কথা বলা বন্ধ হয়ে গেছে। এরপর তিনি কোভিড-১৯ টেস্ট করানোর কথা বলেন। ওখানে আইসিইউ সাপোর্ট দিতে পারবে না বলে জানানোয় স্কয়ারে নিয়ে যাই।
“স্কয়ার বলে, আমাদের পক্ষে ভর্তি নেওয়া সম্ভব নয়, আমরা টেস্ট বন্ধ করে দিয়েছি। পরে সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেলে যাই। তারা বলে, এই পেশেন্টকে কার্ডিয়াক সাপোর্ট দেওয়া দরকার, কিডনির পেশেন্ট যেহেতু। আমাদের এই সাপোর্ট শুরু হয়নি, আমরা পারব না। “সেখান থেকে সোহরাওয়ার্দী কার্ডিয়াকে যাই। তারা রাখতে পারবে না বলে জানায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় কথা বলি, তারাও বলে, এই মুহূর্তে ভর্তি নেওয়া সম্ভব না। আমি মিরপুরের রিজেন্ট হাসপাতালেও গিয়েছি।”
“আমাদের আশপাশে এমন কোনো হাসাপাতাল নেই যেখানে ভর্তি করানোর চেষ্টা করিনি। পরে সাড়ে ৯টার পর যখন আর কিছু করার ছিল না তখন আমরা বাসায় এসে বসে থাকি। কারণ আমাদের আর কিছুই করার ছিল না,” বলেন সুস্মিতা।
অতিরিক্ত সচিব গৌতমের আগে থেকেই যে এ ধরনের সমস্যা হত, মেয়ে সুস্মিতা একজন চিকিৎসক হয়েও এই সঙ্কটের মধ্যে তা কোনো হাসপাতালকে্ই পারেননি। ফলে বাবাকে হারিয়ে একটা আইসিইউ সাপোর্ট না পাওয়ার আপেক্ষ আজীবন বয়ে বেড়াবেন তিনি।
“আমার কাছে অদ্ভুত লেগেছে একজন ডাক্তার হিসেবে আমি জানতাম বাবার কী হয়েছে, কিন্তু আমি কোথাও তাকে আইসিইউ সাপের্টে নিতে পারলাম না। তার একটা আইসিইউ সাপোর্ট হলেই হত, আমি তার হিস্ট্রিটা খুব ভালোমতোই জানি। বাবা রফিকুল আলম স্যারের পেশেন্ট ছিল, পরে আমরা মনোজ জামান স্যারকে দেখাতাম। রফিকুল আলম স্যার বাবাকে ভালোমতোই চিনেন, বাবার সমস্যা মাঝে মাঝে খুব জটিল হয়, তার আইসিইউ সাপোর্ট দরকার হয়।”
সব হাসপাতালে ঘুরেও ভর্তি করাতে ব্যর্থ হয়ে মৃত্যুপথযাত্রী বাবাকে নিয়ে যখন বাসায় বসে আছেন, তখন তাদের এক আত্মীয় অনেক চেষ্টার পর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে একটা ‘সিট ম্যানেজ’ হওয়ার খবর জানান।
সুস্মিতা বলেন, “রাত ১০টার দিকে আমাদের একজন রিলেটিভ একটা রেফারেন্সে কুর্মিটোলায় একটা জেনারেল বেডের অ্যারেঞ্জ করেন। বাবার অক্সিজেনের খুব বেশি দরকার হওয়ায় তার কোভিড-১৯ এর কোনো উপসর্গ না থাকলেও তাকে ওই হাসপাতালে নিযে যাই। বাবাকে আলাদা কেবিনে রাখা হয়।
“শুক্রবার সন্ধ্যা ৭টা থেকে বাবার অক্সিজেন ফল করতে শুরু করল। যে বেডে তাকে রাখা হয়েছিল কোনো সেখানে সরকারি ডাক্তার সেখানে যায়নি। তারা আমাকে ওষুধ বুঝিয়ে দেয়, আমিই ওষুধ খাওয়াচ্ছি, আমার ভাই অক্সিজেন দিচ্ছে।”
সুস্মিতা বলেন, “হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানান, শুক্রবার সকালে কোভিড-১৯ পরীক্ষা করাবেন। আমরাও সেটাই চাইছিলাম। কোভিড-১৯ এর রিপোর্টটা পেলে সেই অনুযায়ী আমরা অন্য ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, প্রয়োজনে ভালো কোনো বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করাতাম। কিন্তু শুক্রবার সারা দিন তারা টেস্টই করায়নি।
“বাবা মারা যাওয়ার পর তারা বলছে, আগেই নমুনা নেওয়া দরকার ছিল। আমরা বললাম, এখন নিয়ে নেন। আমরা এখনও করাতে চাই।”
“আমি ডাক্তার হিসেবে মনে করি, বাবার কোভিড-১৯ এর কোনো উপসর্গ ছিল না। ডায়ালাইসিসের সময় তার আগেও এমন হয়েছে। এই অবস্থায় হাসপাতালগুলো চাইলেই তাকে ভর্তি নিতে পারত। কোভিড-১৯ সন্দেহ হলে প্রয়োজনে আইসোলেশনে রাখতে পারত, কিন্তু কেউ সেটা করেনি,” বলেন সুস্মিতা।
“বাবার প্রোপার টিটমেন্ট হয়নি। আমরা ভয় পাচ্ছিলাম স্ট্রোক করেছে। একটা পা নাড়াতে পারছিলেন না, কথাও বলতে পারছিলেন না। ল্যাবএইডের ইমার্জেন্সি থেকেও বলেছে, উনি মনে হয় স্ট্রোক করেছেন।”
সুস্মিতা বলেন, “আমি আমার বাবাকে নিয়ে সাফার করছি, …এটা নিয়ে আমি কথা বলব। বিশেষ করে নরমাল যারা পেশেন্ট, কোভিড-১৯ না, আমার বাবার মতো কিডনি পেশেন্ট, তারা কী করবেন, তাদের জন্য কী করছেন? কারণ আমি যে হাসপাতালেই গিয়েছি সবাই বলেছে, টেস্ট (রিপোর্ট) আনেন। আমি টেস্টটা কোথায় করাব?”