অবশেষে হেফাজতিরা কহিলেন বিষাদে!

32

আ.ফ.ম. সাঈদ
বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে ৫ মে একটি স্মরণীয় দিন। কারো কাছে এই দিনটি বিষাদের, কারো কাছে শোকের, কারো কাছে আক্ষেপের।
২০১৩ সালের ৫ মে রাজধানীর শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলাম ডাক দিয়েছিল সমাবেশের। আল্লামা আহমদ শফির আহŸানে সেদিন সারা দেশ থেকে দেওবন্দি ধারার কওমি মাদ্রাসার শিক্ষক-ছাত্ররা জমায়েত হয়েছিলেন। ১৩ দফা দাবিতে এই সমাবেশ ডাকা হয়েছিল। এই দাবিগুলো মূলত ছিল নাস্তিক-মুর্তাদদের গ্রেফতার ও বিচার করা, মহানবি (সা.) সম্পর্কে কটূক্তি বন্ধে আইন পাস করা।
শাপলা চত্বরে সেদিন শুধু সমাবেশের কর্মসূচি ছিল। কিন্তু বিকেলে তা বিনা ঘোষণার পরিবর্তন হয়ে যায়। হেফাজতের নেতাকর্মীরা শাপলা চত্বরে অবস্থান কর্মসূচির ঘোষণা দেন। দাবিগুলো না মানা পর্যন্ত তারা সরবেন না বলে জানিয়ে দেন।
এদিকে ৫ মে সারা দিন রাজধানীতে চালানো হয় তান্ডবলীলা। ব্যাপক ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম, চালানো হয় ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও হামলা কিছুই বাদ যায়নি। বিকেলে শাপলা চত্বর থেকে সরে যেতে সরকার আহŸান জানায়। কিন্তু তাতে বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করা হয়নি। বরং উলটো সরকারকে কঠোর হুমকি দেওয়া হয়।
সেই রাতে অনেকে অজানা আতঙ্ক নিয়ে ঘুমিয়েছিলেন। কেউ কেউ ভেবেছিলেন, রাতের মধ্যেই শেখ হাসিনার সরকারের পতন ঘটবে। সকালে ওঠে হয়তো দেখবেন, হেফাজতে ইসলামের সরকার ক্ষমতায় এসেছে।
কিন্তু রাতেই আইনশৃক্সক্ষলা বাহিনীর সমন্বিত অভিযানে শাপলা চত্বর হেফাজতমুক্ত হয়। হেফাজতের নেতাকর্মীরা অবস্থান ছেড়ে পালান।
রাতের এই অভিযান নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ ওঠে। কেউ কেউ বলেন, অভিযানকালে নাকি হেফাজতের কয়েকশ নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন। ‘অধিকার’ নামক একটি এনজিও এমন দাবি করে। হেফাজতের নেতৃবৃন্দও বলেন, তাদের শত শত নেতাকর্মী শহিদ হয়েছেন। কিন্তু সরকার এসব অভিযোগ দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করে। শাপলা চত্বরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানকালে নিহতদের নাম-ঠিকানা দিতে সরকারের পক্ষ থেকে আহŸান জানানো হয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত কেউ এই তালিকা দিতে পারেনি।
সেদিন রাজধানীতে নজিরবিহীন তান্ডবলীলা চালানো এবং সমাবেশের পর অবস্থান কর্মসূচির আকস্মিক ঘোষণার নেপথ্য কারণ কী ছিল? সরকারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাসহ অনেক বোদ্ধাও বলেছিলেন, এর নেপথ্যে ছিল জামায়াত-শিবির এবং বিএনপির সহযোগিতা-প্ররোচনা। কিন্তু হেফাজতে ইসলামের নেতৃবৃন্দ দৃঢ়ভাবে সে কথা অস্বীকার করেছিলেন।
কথায় বলে, ‘ধর্মের কল বাতাসে নড়ে’ এবং ‘সত্য কখনো চাপা থাকে না’। এই দুটি কথার সত্যতা আবারও প্রমাণিত হচ্ছে। বর্তমানে হেফাজতের ইসলামের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে ও ফেসবুকে অকপটে স্বীকার করছেন, সেদিন তাদেরকে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা মাঠে নেমে সহযোগিতা করেছিল। তাই কবির ভাষায় বলতে হয়; ‘এতক্ষণে অরিন্দম কহিলা বিষাদে, জানিনু কেমনে আসি ল²ণ পশিল রক্ষঃপুরে।’
আল্লামা আহমদ শফি একজন প্রখ্যাত আলেম ও আল্লাহর ওলি বলে সুবিদিত। হজরত মুহাম্মদ সা. সম্পর্কে কয়েক ব্যক্তির জঘন্য কটূক্তি তিনি সহ্য করতে পারেননি। কোনো মুসলমানই তা মেনে নিতে পারে না। তাই তিনি আন্দোলনে নামেন, শাপলা চত্বরে সমাবেশের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। আল্লামা আহমদ শফি জীবনে কখনো রাজনীতি করেননি। তিনি অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। যদিও তাঁর মুর্শিদ মাওলানা হুসাইন আহমদ মদনি (র.) ছিলেন প্রখ্যাত আলেম ও ওলিয়ে কামেল। পাশাপাশি তিনি ছিলেন দূরদর্শী ও বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ। কিন্তু রাজনীতির জটিল ম্যারপ্যাঁচ সম্পর্কে আল্লামা আহমদ শফির ধারণা না থাকায় তাঁর আন্দোলনকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে জামায়াত-শিবির ও বিএনপি নেপথ্যে মাঠে নেমেছিল। হেফাজতে ইসলামের নীতিনির্ধারণী ব্যক্তিদের মধ্যে কয়েকজন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে রয়েছেন। তারা বিএনপির ২০ দলীয় জোটেরও শীর্ষস্থানীয় নেতা। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের পতন। এই অভিসন্ধির কারণে সেদিন হেফাজতে ইসলামের সমাবেশের কর্মসূচির অবস্থান কর্মসূচিতে বদলে যায়। হেফাজত নেতাকর্মীদের ছদ্মাবরণে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা চালায় নজিরবিহীন অরাজকতা ও সন্ত্রাসী তৎপরতা ও তান্ডবলীলা। এতে হেফাজতে ইসলাম বিতর্কিত হয়, সংগঠনের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ সরকারের রোষানলের শিকার হন। কিন্তু অরাজকতার নেপথ্য নায়ক, ইন্ধনদাতা ও সহযোগিতাকারী জামায়াত-শিবির ও বিএনপির কাউকে ৫ মে-র ঘটনায় আসামি হতে হয়নি। তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে।
২০১৩ সালে হেফাজতে ইসলামের নাস্তিক-মুর্তাদবিরোধী আন্দোলনকালে জামায়াত-শিবিরের কাছে আল্লামা আহমদ শফি ছিলেন অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় ও সম্মাননীয়। তাঁর নামের পূর্বে তারা ‘শায়খুল ইসলাম’ লিখত। অথচ আল্লামা আহমদ শফির মুর্শিদ মাওলানা হুসাইন আহমদ মদনি (র.)-কে ‘শায়খুল ইসলাম’ বলা হয়। আল্লামা আহমদ শফিকে জামায়াত-শিবির ছাড়া আর কেউ ‘শায়খুল ইসলাম’ বলেনি। কিন্তু ৫ মে তাঁর ঘাড়ে বন্ধুক রেখে শিকার করতে ব্যর্থ হওয়া তাদের শ্রদ্ধাভক্তিও ওঠে গেছে। এখন তাদের অনেকে ফেসবুকে আল্লামা আহমদ শফিকে অত্যন্ত নোংরা ও অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল করে।
বিএনপির অঘোষিত মুখপত্র ‘দৈনিক আমার দেশ’ হেফাজতে ইসলামের আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে জোরালো ভ‚মিকা রাখে। তিলকে তাল বানিয়ে ও ভিত্তিহীন নানা খবর প্রকাশ করে পত্রিকাটি অপসাংবাদিকতার নজির সৃষ্টি করে। এই পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানও কিছুদিন পূর্বে আল্লামা আহমদ শফি সম্পর্কে নানা কটূক্তি ও তাঁকে গালাগাল করেছেন।
(পুনশ্চ : ২০১৩ সালের ৫ মে বিকেলে তৎকালীন স্থানীয় সরকার, পল্লি উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সন্ধ্যার মধ্যে শাপলা চত্বর ছেড়ে যেতে হেফাজতের নেতাকর্মীদের আহŸান জানিয়েছিলেন। এর উত্তরে হেফাজতের এক বিশিষ্ট নেতা ও একটি ইসলামি রাজনৈতিক দলের শীর্ষস্থানীয় নেতা টিভি ক্যামেরায় চিবিয়ে চিবিয়ে মন্ত্রীকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন, ‘রাতের মধ্যে আপনারা ক্ষমতা ছেড়ে কে কীভাবে ঢাকা থেকে পালাবেন, সেই চিন্তা করুন।’ ওই হুজুর-নেতা এখনো ইস্যুতে সেদিনের মতো চিবিয়ে চিবিয়ে হুংকার ছাড়েন, সরকারকে হুমকি দেন। তখন ২০১৩ সালে ৫ মে সন্ধ্যায় তার হুংকারের দৃশ্য চোখের পর্দায় ভেসে ওঠে।