নামেই কেবল ত্রাণ কমিটি জবাবদিহি নেই : ত্রাণ নিয়ে স্বজনপ্রীতি, অনিয়ম যত

31

সালাম মশরুর::
পর্যাপ্ত ত্রাণ বরাদ্দ সত্তে¡ও অনেকে ত্রাণ পাননি। নামেই কেবল ত্রাণ কমিটি। তালিকা তৈরি ও ত্রাণ বিতরণ নিয়ে অভিযোগের অন্ত নেই। কোনো জবাবদিহি নেই। সরকারের দেয়া ত্রাণ নিয়ে মুনাফা নিচ্ছে সুবিধাবাদী মহল। যে-কোনো সংকট মোকাবিলায় সমন্বিত প্রচেষ্টার প্রয়োজন। রাষ্ট্রীয় সংকটে সরকার ও জনগণ ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে এলে এর সুফল পাওয়া যায়। দেশে মহামারির কারণে সংকট সৃষ্টি হয়েছে।করোনা ভাইরাস নিয়ে মানুষের জীবনমরণ যুদ্ধ চলছে। নিজেদের রক্ষা করতে মানুষের স্বেচ্ছাবন্দি জীবনযাপন ছাড়া কোনো উপায় নেই। এই কারণে বিশেষ করে গরিব অসহায়, নি¤œ আয়ের মানুষের খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। এই পর্যায়ে সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, সামাজিক সংগঠন ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। ব্যক্তি উদ্যোগে যতটুকু ত্রাণ সামগ্রী মানুষের কাছে পৌঁছানো হচ্ছে, তার কোনো হিসাবের প্রয়োজন নেই। এটা নিয়ে কারো মাথাব্যথাও নেই। ব্যক্তি বা সংগঠন তার মত করে খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করলে কারো কিছু বলার নেই। এ নিয়ে একজন গরিব লোক কারো কাছে ফরিয়াদি হতেও পারবে না। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করার ক্ষেত্রে মানুষের অধিকারের প্রশ্নটি বিবেচনায় আসে। মানুষের জীবন বাঁচাতে সরকারের প্রচেষ্টার কোনো ঘাটতি নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশকে সার্বক্ষণিক তার নজরদারিতে রেখেছেন। সংকট মোকাবিলায় তার প্রচেষ্টা সকল ক্ষেত্রে দৃশ্যমান। দেশে বর্তমানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে গরিব-অসহায় মানুষের খাদ্য ব্যবস্থা। সরকারের পক্ষ থেকে খাদ্য পরিস্থিতি মোকাবিলায় পর্যাপ্ত পরিমাণ খাদ্য সামগ্রী বিতরণের ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং চলছে। বিভিন্ন ধাপে ত্রাণ বিতরণ, রেশন ব্যবস্থা, কম মূল্যে খাদ্য দ্রব্য ক্রয়ের ব্যবস্থা মানুষকে সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু যথাযথভাবে সরকারের দেয়া ত্রাণ ও রেশন কার্ড বিতরণ না হওয়ায় গরিব-অসহায় মানুষের একটি অংশ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ত্রাণ পাওয়ার দাবিদারদের তালিকা তৈরি ও বিতরণ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি করে কমিটি গঠন করা হয়েছে। এলাকার কোন শ্রেণির লোকদের নিয়ে এই কমিটি গঠন করা হবে তারও একটি দিঙ্নির্দেশনা রয়েছে। তালিকা তৈরি করে কি পরিমাণ ত্রাণ, কীভাবে বিতরণ করা হবে তারও সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এই নির্দেশনা কার্যকর হচ্ছে না। বিভিন্ন এলাকায় সংশ্লিষ্ট কাউন্সিলর মনগড়া পকেট কমিটি করে নিজের মতো কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। কাদের নিয়ে ত্রাণ পরিচালনা কমিটি গঠন করার নির্দেশনা রয়েছে, কি পরিমাণ ত্রাণ বিতরণ করা হবে, কারা, কোন শ্রেণির লোক ত্রাণ বা রেশন কার্ডের সুবিধা পাবে এই তথ্যগুলো সকলের জানা প্রয়োজন। কিন্তু বাস্তবে সব কিছুই অন্ধকারে। ত্রাণ গ্রহণকারী, সংশ্লিষ্ট এলাকাবাসী, কারো কাছেই কোনো তথ্য নেই। সিটি কর্পোরেশন বলছে, ত্রাণ গ্রহীতার তালিকা তাদের ওয়েবসাইটে পাওয়া যাবে। কিন্তু একজন ত্রাণগ্রহীতা গরিব-অসহায় লোক কি ওয়েবসাইট বুঝবে? এলাকার সাধারন মানুষ এটি জানার জন্য ওয়েবসাইট খুঁজতে যাবে কেন ? ত্রাণ কমিটি গঠন, ত্রাণের পরিমাণ, কারা ত্রাণ পাচ্ছে সে বিষয়টির স্বচ্ছ থাকতে হবে। এলাকার প্রতিটি লোক এ ব্যাপারে অবগত থাকবে। সেটা স্থানীয়ভাবে জানানোর ব্যবস্থা নিতে হবে। একজন ত্রাণ গ্রহীতা জানে না সরকার তার জন্য কী পরিমাণ ত্রাণ বরাদ্দ দিয়েছেন। এলাকার সচেতন মহলও জানে না, এই এলাকার কতটুকু ত্রাণ বরাদ্দ এসেছে, আর কীভাবে বিতরণ করা হচ্ছে। এলাকার ত্রাণ গ্রহীতাদের ভাগ্যবিধাতা হচ্ছেন কাউন্সিলর। সরকারের মাল আর দাতা তিনি। তিনি যাকে খুশি তাকে দেবেন। কারো কিছু বলার নেই। একজন গরিব লোক কোনো কারণে কাউন্সিলরের রোষানলে থাকায় ত্রাণ পায়নি অথচ তার প্রতিবাদ করার জায়গাও নেই। একজন লোক ত্রাণ পায়নি সেটা বলার জায়গা নেই। আর এই বিষয়ে জবাবদিহি না থাকায় ত্রাণ নিয়ে তুগলকি কান্ড ঘটছে। ইতোমধ্যে কয়েক দফা ত্রাণ বিতরণ করা হয়ে গেছে।
বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে পৃথকভাবে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণের তালিকা হচ্ছে। এই পর্যন্ত যে পরিমাণ ত্রাণ সামগ্রী বরাদ্দ দেয়া হয়েছে তা যথাযথভাবে বিতরণ করা হলে গরিব, অসহায় নি¤œ আয়ের সকল মানুষের ঘরে সেটা পৌঁছানোর কথা। জনগণের জন্য সরকারের এই প্রচেষ্টার খবরও যথাযথ ভাবে জনগণের কাছে পৌঁছার কথা। দুঃসময়ে মানুষের পাশে রয়েছে সরকার। সরকার মানুষকে ত্রাণ দিচ্ছে, সে সংবাদ মানুষের মনোবল আরো দৃঢ় করবে। পর্যাপ্ত ত্রাণ বরাদ্দ সত্তে¡ও বিভিন্ন মানুষ ত্রাণ সহায়তা পায়নি। মানুষ ক্ষোভ-অসন্তোষ নিয়ে বিভিন্ন স্থানে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। আবার বিভিন্ন এলাকায় একই ব্যক্তি একাধিকবার ত্রাণ পেয়ে অনেকে খোলাবাজারে বিক্রিও করছেন। নিজের দল ভারী ও পক্ষের লোক থাকার সুবাদে ত্রাণ পাওয়ার পর্যায়ে নেই, অবস্থাসম্পন্ন এমন লোককেও রেশন কার্ড ও ত্রাণ সুবিধা দেয়া হচ্ছে।
নগরীর ৬ নম্বর ওয়ার্ডের ত্রাণ কমিটির সদস্য ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল হোসেন মাসুদ অভিযোগে জানান, তিনি এই ওয়ার্ডের ত্রাণ কমিটির সদস্য হওয়া সত্তে¡ও তার ওয়ার্ডে কি পরিমাণ ত্রাণ বরাদ্দ এসেছে তা তিনি জানেন না। এমনকি গরিব লোকদের তালিকা তৈরি করতেও তাদের কোনো মতামত নেয়া হচ্ছে না। স্থানীয় কাউন্সিলর তার পছন্দমতো লোকদের নাম তালিকাভুক্ত করছেন। এতে অনেকেই বাদ পড়ছেন। সুষ্ঠু তালিকা তৈরি নিয়ে কথা বলেও কোনো সুফল মিলছে না। কাউন্সিলর তার পছন্দমাফিক তালিকা প্রস্তুত করার কারণে পর্যাপ্ত ত্রাণ সহায়তা সত্তে¡ও এলাকার অনেক গরিব অসহায় লোক ত্রাণ পায়নি। তিনি বলেন, ওয়ার্ডে ১৬শ লোকের নাম তালিকাভুক্ত করার সংবাদ পাওয়া গেছে। ত্রাণ কমিটির সদস্য হওয়া সত্তে¡ও আমাদেরকে আড়ালে রেখে কাউন্সিলর তার পছন্দের লোকদের নাম তালিকাভুক্ত করে নিচ্ছেন। ত্রাণ বিতরণ, রেশন কার্ডের সুবিধা সরকারের পক্ষ থেকে করা হলেও কাউন্সিলর কৌশলে তার লোক দ্বারা এই সকল ত্রাণ ও রেশন কার্ডের সুবিধা কাউন্সিলর করছেন বলে নিয়মিত প্রচার চালানো হচ্ছে। এই সংকটে মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসা সরকারের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করে চলেছেন। সরকারের দেয়া ত্রাণ সামগ্রী দিয়ে তিনি আগামী নির্বাচনে জয় লাভ করার পথ সুগম করছেন।
এ ব্যাপারে রোববার ১০ মে ৬ নম্বর ওয়ার্ডের ত্রাণ কমিটির সদস্য হিসাবে ৬ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি হায়দার মোহাম্মদ ফারুক হোসেন, অপর সদস্য ওয়ার্ড অওয়ামী লীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট কামাল হোসেন ও সদস্য ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল হোসেন মাসুদ সিটি মেয়রের কাছে বর্তমান তালিকাভুক্তির কার্যক্রম স্থগিত রাখা ও অনিয়মের তদন্ত দাবি করে লিখিত অভিযোগ দাখিল করেছেন।
ত্রাণ নিয়ে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতির কারণে নিরীহ মানুষ হয়রানির শিকার হচ্ছে, প্রাপ্য সুবিধা থেতে বঞ্চিত হচ্ছে। ত্রাণ বিতরণের দায়িত্বে নিয়োজিতরা নানান ভাবে তাদের আখের ঘোচাতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন।
সরকারের বরাদ্দকৃত ত্রাণ বিতরণ ও রেশন কার্ডের তালিকা তৈরি নিয়ে বিভিন্ন স্থানে স্বজনপ্রীতি ও অনিয়মের অভিযোগ উঠছে। স্থানীয় কাউন্সিলরদের অনেকেই নিজেদের পছন্দের লোকদের নাম তালিকাভুক্ত করছেন। যারা নির্বাচনে তাদের বিপক্ষে ছিলেন তাদেরকে কৌশলে তালিকার বাইরে রাখছেন। এনিয়ে সুবিধাবঞ্চিত পরিবারের লোক হতাশায় ভুগছেন।
সিলেট সিটি কর্পোরেশনের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের অনেকেই রেশনের কার্ডের সুবিধা থেকে বঞ্চিত থাকার কথা উল্লেখ করে বলেন, এই ওয়ার্ডে বিগত নির্বাচনে তারা বর্তমান কাউন্সিলর বিএনপি নেতা শামীমের বিপক্ষে ছিলেন। তাই এখন তাদের নাম তালিকাভুক্তি নিয়ে নানান টালবাহানা করা হচ্ছে। অভিযোগকারীরা জানন সাম্প্রতিক সময়ে সিলেট সিটি কপোরশন থেকে নগরীর নি¤œ আয়ের মানুষের মধ্যে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করা হয়। প্রতি ওয়ার্ডে কাউন্সিররা ত্রাণ বিতরণ করেন। এখানে প্রায় ৪০টি পরিবারকে ত্রাণ সামগ্রী দেয়া হয়নি। কাউন্সিলরের কাছ থেকে ত্রাণ না পেয়ে তারা সিটির মেয়র বরাবরে ত্রাণের জন্য আবেদন করেন কিন্তু তাতেও তারা কোনো ফল পাননি। কাউন্সিলরের মাধ্যমে রেশন কার্ড তৈরির তালিকা প্রস্তুত করার কারণে তারা তাদের ভোটের পাল্লা ভারী করার পথ সুগম করছেন। সরকারের রেশন ব্যবস্থার সুফল যোগ হচ্ছে তাদের প্রাপ্তির খাতায়।
বর্তমান সময়ে রেশন কার্ডের মাধ্যমে গরিব শ্রেণির লোক নিত্য প্রযোজনীয় জিনিস পাওয়ার প্রত্যাশা করলেও যথাযথভাবে তালিকা তৈরির অভাবে এই প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
বিভিন্ন এলাকায় জনপ্রতিনিধির বিরাগভাজনরা ত্রাণ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, আবার অনেক স্থানে তাদের পছন্দের লোকরা একাধিক সুবিধা পাচ্ছেন। জনপ্রতিনিধিদের উপর নির্ভরশীল হওয়ার কারণে সুবিধাবঞ্চিতরা তাদের অভিযোগ জানানোর কোনো সুযোগ নেই। ত্রাণ ও রেশন বিতরণের ক্ষেত্রে কারচুপি প্রতিরোধে সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণ কামনা করছেন ভুক্তভোগীরা। রেশন কার্ডের তালিকা তৈরিসহ সরকারের সাহায্য যথাযথ ভাবে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছার জন্য নির্ভরযোগ্য যাচাই কমিটি গঠন করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহি ও ভুক্তভোগীদের অভিযোগ জানানোর সুযোগ থাকা বাঞ্ছনীয়। ত্রাণ ও রেশন বিতরণের সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের স্বজনপ্রীতি, কারচুপি অনিয়মের বিষয়ে তাৎক্ষণিক দৃষ্টান্তমূলক কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।