সবুজ সিলেট ডেস্ক::
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের হাতে গড়া সংগঠন এরশাদ ট্রাস্টের অঘোষিত নিয়ন্ত্রণ এখন বিদিশার হাতে। ট্রাস্ট পরিচালনা বোর্ডে যারা রয়েছেন তাদের অধিকাংশ বিদিশারই পছন্দের লোক। শুধু তাই নয়, জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদও নিয়মিত আলাপচারিতা চালিয়ে যাচ্ছেন বিদিশার সঙ্গে।
জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীদের মতে, এই পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনে দলটির বর্তমান চেয়ারম্যান জি এম কাদেরই দায়ী। তিনি জাতীয় পার্টির গত কাউন্সিলে দলটির কয়েকজন নেতাকে বাদ দেন। তারা বিদিশার পক্ষ নিয়ে বারিধারা প্রেসিডেন্ট পার্কে বিদিশার অবস্থান পাকাপক্ত করে দিয়েছেন। শুধু তাই নয় বিদিশার সঙ্গে বেগম রওশন এরশাদেরও যোগাযোগ রয়েছে।
এ সম্পর্কে জানতে রওশন এরশাদকে একাধিকবার ফোন করেও পাওয়া যায়নি। তবে বিদিশা জানান, রওশন এরশাদ টেলিফোন করে এরিকের খোঁজ-খবর নিয়ে থাকেন।
২০১৯ সালে এরশাদ নিজের নামে ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়া মৃত্যুও আগে তার সম্পত্তি উইল করে যান। জাপা’র প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যানের এই ট্রাস্টে কী আছে— এ বিষয়ে খোঁজ নিতে গিয়ে জানা যায়, মৃত্যুর সময় কোনো কৃষিজমি ছিল না এরশাদের। ঠাকুরগাঁওয়ে ধর্মগড়ে ১২০ বিঘার মতো কৃষিজমি ছিল। সেই জমি অনেক আগেই এতিমদের নামে লিখে দিয়েছিলেন। তার প্রতিষ্ঠিত এতিমখানায় অধ্যয়ন করা অনাথদের ১০ বিঘা জমি লিখে দিয়েছিলেন তিনি।
কৃষি জমি না থাকলে এরশাদের ট্রাস্টের সম্পদে পরিমাণ নেহায়েত কম নয়। ট্রাস্টের নামে এরশাদ উইল করে গেছেন তার নামে থাকা সব এফডিআর, রংপুরের পদাগঞ্জে অবস্থিত পল্লীবন্ধু কোল্ড স্টোরেজ, বারিধারার ফ্ল্যাট (প্রেসিডেন্ট পার্ক, যেখানে তিনি নিজে থাকতেন), গুলশানের ফ্ল্যাট, বনানী বিদ্যা নিকেতনের বিপরীতে অবস্থিত একটি ফ্ল্যাট, বনানী ইউআই শপিং কমপ্লেক্সের দু’টি দোকান, ৬৫ শতক জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত রংপুর শহরে বাসভবন (পল্লী নিবাস) ও নিজের নামে কেনা পাঁচটি গাড়ি।
তবে ট্রাস্টে প্রকৃতপক্ষে কী পরিমাণ সম্পদ রয়েছে, সে বিষয়ে জানা নেই বলেই জানালেন জাতীয় পার্টির বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা। একই দশা দলের মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গা বলেন, কী পরিমাণ সম্পদ রয়েছে— তা আমার জানা নেই। এসব বিষয় ট্রাস্টের সঙ্গে যারা যুক্ত, তারা বলতে পারবেন।
জানা যায়, কোল্ড স্টোরেজ স্থাপনের সময়ে চাচাত ভাই সামছুজ্জামান মুকুলকে কিছু শেয়ার লিখে দিয়েছিলেন। সে কারণে পুরো কোল্ড স্টোরেজ ট্রাস্টে লিখে দিলেও এর থেকে প্রাপ্ত আয়ের ২০ শতাংশ হিস্যা যায় মুকুলের নামে। বাকি ৮০ শতাংশ মুনাফা জমা হয় ট্রাস্টের ফান্ডে। তবে কোল্ড স্টোরেজের মূলধনে মুকুলের কোনো ভাগ নেই।
ট্রাস্ট পরিচালনার জন্য পাঁচ সদস্যের বোর্ড রাখার বিধান করা হয় ট্রাস্ট গঠনের সময়। প্রয়াত এরশাদ ছাড়া ট্রাস্টের বাকি সদস্যরা ছিলেন— এরশাদের ছেলে এরিখ এরশাদ, ভাতিজা মেজর (অবসরপ্রাপ্ত) খালেদ আক্তার, ব্যক্তিগত সহকারীি জাহাঙ্গীর আলম ও চাচাত ভাই সামছুজ্জামান মুকুল (রংপুরের বাসার তত্ত্বাবধায়ক)। এরশাদের মৃত্যুর পর ট্রাস্টের চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন মেজর (অবসরপ্রাপ্ত) খালেদ।
ট্রাস্টিদের কোনো রকম সম্মানি বা ভাতা নেওয়ার সুযোগ রাখা হয়নি ট্রাস্টের গঠনতন্ত্রে। বলা হয়েছে, বোর্ডের সদস্যরা কাজ করবেন স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে। ট্রাস্টের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ বিক্রি বা মালিকানা পরিবর্তনেরও কোনো ক্ষমতা দেওয়া হয়নি।
ট্রাস্ট পরিচালনার নীতিমালায় বলা হয়েছে, মুনাফার অর্থে পরিচালিত হবে এই ট্রাস্ট। ট্রাস্টের মুনাফায় প্রথমত ব্যয় হবে এরিখ এরশাদের ভরণপোষণে। সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া হয়েছে এরশাদের অবর্তমানে এরিখের ভরণপোষণের বিষয়টি। এরিখের পরবর্তী প্রজন্মও (যদি থাকে) এখান থেকে সুবিধাপ্রাপ্ত হবেন। তবে এরিখের পরবর্তী প্রজন্ম না থাকলে সেক্ষেত্রে পুরো সম্পদ চলে যাবে ওয়াকফ এস্টেটের অধীনে।
এরিখের ভরণপোষণের পর উদ্বৃত্ত অর্থ সেবামূলক কাজে ব্যয় হবে। এক্ষেত্রে হঠাৎ কোনো মানবিক বিপর্যয় দেখা দিলে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হলে তাদের পাশে দাঁড়াবে ট্রাস্ট। দুস্থ অসহায়, এতিমদের আজীবন ভাতা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। যেহেতু এফডিআর থেকে বছরান্তে আয় আসবে। সে কারণে ট্রাস্টের আর্থিক বিবরণী অডিট করার বিধান রাখা হয়েছে।
পার্টির সূত্র বলছে, এরশাদ তার ট্রাস্ট গঠন করার সময় দলের কাউকে তেমন একটা যুক্ত করেননি এর প্রক্রিয়ায়। ফলে দলের নেতাদের তেমন কোনো প্রভাবই এই ট্রাস্টে নেই। আর সেই সুযোগেই রওশন এরশাদের প্রচ্ছন্ন সায় নিয়ে বিদিশা ট্রাস্ট নিয়ন্ত্রণ করছেন। এমনকি তিনি এরশাদের প্রেসিডেন্ট পার্কেও বর্তমানে অবস্থান করছেন।
এরশাদের তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রী হয়েও বিদিশা বারিধারায় প্রেসিডেন্ট পার্কে কীভাবে অবস্থান করছেন— জানতে চাইলে জাপা মহাসচিব রাঙ্গাঁ বলেন, এরিখ যদি তার মাকে রাখতে চায়, তাহলে সেখানে বিদিশা থাকতে পারেন। আর বিষয়টি সম্পূর্ণ নির্ভর করছে ট্রাস্টের পরিচালনা বোর্ডের ওপরে। এ ক্ষেত্রে আমাদের বলার তেমন কিছু বলার নেই।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিদিশা বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট পার্কে থাকতে আমার কোনো অসুবিধা নেই। আমার ছেলে প্রতিবন্ধী। প্রতিবন্ধী ছেলের কাছে মা থাকবেন— এটি তো আইনেই আছে। আর প্রেসিডেন্ট পার্কে আমার অবস্থান বিষয়ে বোর্ডের কারও সম্মতি আছে কি নেই, সে বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই।’
ট্রাস্টের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেওয়া প্রসঙ্গে বিদিশা অল্প কথায় সাফ বলে দেন, ট্রাস্টের সম্পত্তির ওপর আমার কোনো লোভ-লালসা নেই।’
বিদিশা আসবেন রাজনীতিতেও?
এদিকে, জাতীয় পার্টির শীর্ষ দুই পদে আসীন আছেন এরশাদের স্ত্রী রওশন ও ভাই জি এম কাদের। গুঞ্জন আছে, বিদিশাও পার্টির সামনে সারিতে চলে আসতে পারেন। তিনি হতে পারেন জাতীয় পর্যায়ের নীতি-নির্ধারকদের একজন। আর এতে জাতীয় পার্টির শীর্ষ পদে থাকা কয়েকজন নেতা ছাড়াও সায় দিচ্ছেন দুয়েকজন এমপি।
এ প্রসঙ্গে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গা বলেন, ‘বিদিশা জাতীয় পার্টির সদস্য নন। তাকে সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ পার্টি থেকে বহিষ্কার করেন। যদি তিনি নিয়ম-কানুন মেনে জাতীয় পার্টির সদস্য হতে চান, তা হলে অবশ্যই তাকে গ্রহণ করব।’
তবে বহিষ্কারের বিষয়টি অস্বীকার করেন বিদিশা। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ আমাকে জাতীয় পার্টি থেকে বহিষ্কার করেনি। তিনি আমার সদস্য পদ স্থগিত করেছিলেন। আমাকে বহিষ্কার করা হলে সে ডক্যুমেন্ট জাতীয় পার্টিতে অবশ্যই থাকবে। আমার কাছে বহিষ্কারের চিঠি আসবে এটিই নিয়ম। আমার কাছে বহিষ্কার করার কোনো চিঠি আসেনি। সদস্য পদ স্থগিত রাখার চিঠি এসেছিল।’
জাতীয় পার্টির রাজনীতিতে আসার গুঞ্জন অবশ্য উড়িয়ে দিচ্ছেন না তিনি। বিদিশা বলেন, ‘জাতীয় পার্টির মূল ঘাঁটি রংপুরে। রংপুরের লোকজন যদি মনে করেন জাতীয় পার্টিতে আমার আসা উচিত, তা হলে অবশ্যই জাতীয় পার্টির রাজনীতিতে নিজেকে বিলিয়ে দেবো।’