অনলাইন ডেস্ক: ৫০ বছর পর মায়ের কোলে ফিরলেন নরওয়ে যাওয়া এলিজাবেথ ফিরোজা। এ সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন স্বামী হ্যানরি। সাদা প্রাইভেট কার নিয়ে রাজধানী ঢাকা থেকে তাঁরা চলে আসেন মাদারীপুরের শিবচরে। পরে শিবচরের মাদবরচর ইউনিয়নের পোদ্দারচর গ্রামে তাঁরই বংশের একমাত্র ভাতিজা সেলিম সরদারের মাধ্যমে নিজবাড়িতে আসেন এলিজাবেথ ফিরোজা ও তাঁর স্বামী হ্যানরি।
ভরণপোষণের সামর্থ্য না থাকায় ৫০ বছর আগে সরকারি শিশু সদনে রেখে আসা সেই ছোট্ট মেয়েকে ফিরে পেয়ে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করেন বৃদ্ধা ফিরোজা বেগম। বৃহস্পতিবার সকালে মায়ের সঙ্গে কয়েক ঘণ্টা কাটানোর পর বিকেলেই স্বামীর সঙ্গে রাজধানী ঢাকায় ফিরে যান এলিজাবেথ।
জানা গেছে, ১৯৭৪ সালের দিকে ঢাকায় আসেন মাদারীপুরের শিবচরের বছির সরদার ও তাঁর স্ত্রী ফিরোজা বেগম।
ঢাকার মোহাম্মদপুরে তাঁরা ভাড়া বাসায় থাকতেন। ১৯৭৫ সালের শুরুর দিকে ঢাকায় বছির সরদার খুন হন। তখন ফিরোজা বেগম ছিলেন পাঁচ মাসের গর্ভবতী। স্বামীর মৃত্যুর পর অসহায় হয়ে পড়েন ফিরোজা।
বিভিন্ন আত্মীয়-স্বজনের কাছে চেয়েও কোনো সহযোগিতা পাননি। ওই বছরের ১৫ জুলাই ফিরোজা বেগম এক ননদের বাসায় কন্যাসন্তানের জন্ম দেন। নাম রাখেন মৌসুমী। ১৩ বছরের কিশোরী এক নবজাতকের মা ফিরোজা বেগম হয়ে পড়েন দিশাহারা।
নবজাতককে কী করে বড় করবেন সে চিন্তায় তিনি পাগলপ্রায়।
মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও কোনো লাভ হয়নি। তখন এক প্রতিবেশী তাঁকে পরামর্শ দেন সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরের শিশু সদনে শিশুটিকে দিয়ে দেওয়ার। ১৯৭৫ সালের ৩০ আগস্ট ঢাকায় সমাজসেবা অধিদপ্তরের শিশু সদনে দেড় মাস বয়সী শিশুকে বিনা শর্তে দিয়ে যান ফিরোজা বেগম। কখনো আর ভাবেননি মেয়েকে ফিরে পাবেন।
সেই বছরের ১৭ জুলাই নরওয়ের নাগরিক ডাক্তার রয় রয়েড আর তাঁর স্ত্রী ক্যারেন রয়েড একটি শিশুসন্তান দত্তক চেয়ে বাংলাদেশ সরকারের আন্তর্দেশীয় দত্তক প্রকল্পে সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে আবেদন করেন। এরপর চুক্তি, দুই দেশের মধ্যে কাগজপত্র লেনদেন আর পাসপোর্ট করে ছোট্ট মৌসুমীকে নরওয়ের ওই দম্পতি দত্তক নিয়ে নরওয়ে চলে যান। তাঁর নতুন নাম হয় এলিজাবেথ ফিরোজা।
চিকিৎসক রয় রয়েড আর গৃহিণী মা ক্যারেন এলিজাবেথের কাছে যত্নে বড় হতে থাকেন এলিজাবেথ। সেখানে ১০ বছর বয়সে এলিজাবেথ জানতে পারেন তাঁর জন্ম বাংলাদেশে।
অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন এলিজাবেথ ফিরোজা। সেখানেই পরিচয় হেনরির সঙ্গে। নিজে স্বাস্থ্যকর্মী আর ঘর বাঁধেন সমাজকর্মী হেনরির সঙ্গে। ২২ বছর বয়সে প্রথম সন্তান জন্মের আগে ডাক্তার জানতে চান এলিজাবেথের মা-বাবার কোনো অসুখ ছিল কি না। জানতে চান পরিবারের পুরো ইতিহাস। এলিজাবেথের মনে নতুন করে প্রশ্ন জাগে তাঁর জন্মদাত্রী মা কে? তাঁর পরিবার কোথায়? তখন এলিজাবেথ তাঁর মাকে খুঁজে বের করার পরিকল্পনা নেন। তাই তিনি বিভিন্ন মাধ্যমে বাংলাদেশের সমাজসেবা দপ্তরে যোগাযোগের চেষ্টা করেন।
গত ২৩ মার্চ এলিজাবেথ ফিরোজা আসেন বাংলাদেশে। এরই মধ্যে যোগাযোগ করেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিচালক মোস্তাফা জামিল খানের সঙ্গে। সেখান থেকে যান সমাজসেবা অধিদপ্তরে। সমাজসেবা অফিসার আবু নাঈম খুঁজে বের করেন ৫০ বছরের পুরনো ফাইল। নতুন করে আশার আলো দেখেন এলিজাবেথ। জানতে পারেন তাঁর বাড়ি মাদারীপুরের শিবচরের মাদবরচর ইউনিয়নের পোদ্দারচর গ্রামে।
পরে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে ঢাকা থেকে ফোনে যোগাযোগ করেন এলিজাবেথ। সবাই মিলে তাঁর দুঃসম্পর্কের এক আত্মীয় সেলিম সরদারকে খুঁজে বের করেন। তাঁর কাছে জানতে পারেন তাঁর মা ফিরোজা বেগম বেঁচে আছেন। স্বামী বছিরের মৃত্যুর পর ফিরোজা বেগম আরেকজনকে বিয়ে করেন। বর্তমানে সেই স্বামীর বাড়ি শরীয়তপুর জেলার জাজিরা উপজেলার নাওডোবা এলাকায় বসবাস করেন তিনি। হারিয়ে যাওয়া মেয়ে ফিরে আসার খবরে গত বৃহস্পতিবার সকালে ৬৩ বছর বয়সী ফিরোজা বেগম ছুটে আসেন পোদ্দারচর গ্রামে সেলিম সরদারের বাড়িতে। এরপর এক অন্যরকম দৃশ্য। মা-মেয়ের দেখাকালে উভয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। কেউ কারো কথা বুঝতে না পারলেও ইশারায় চলে ভাববিনিময়।
সেখানে থেকে মা ও মেয়ে শরীয়তপুরের জাজিরার নাওডোবা গ্রামে যান। এলিজাবেথ তাঁর মায়ের জন্য আনা নতুন জামা-পায়জামা, কসমেটিকসহ বিভিন্ন উপহার তুলে দেন মায়ের হাতে। নিজের গলার দামি একটি চেইনও নিজ হাতে মায়ের গলায় পরিয়ে দেন। স্থানীয় একটি বাজার থেকে চাল, ডাল, চিনি, দুধ, আটা, ময়দা, সেমাইসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু সামগ্রী কিনে দিয়ে যান মাকে। দিনভর মা-মেয়ে একসঙ্গে সময় কাটিয়ে ঢাকায় ফিরে যান এলিজাবেথ ফিরোজা।
এলিজাবেথের দুঃসম্পর্কের ভাতিজা সেলিম সরদার বলেন, ‘আমরা কোনো দিন জানতামও না যে আমার দাদি বেঁচে আছেন। এমনকি তিনি তাঁর মেয়েকে শিশু সদনে রেখে এসেছিলেন। ঢাকা থেকে তাঁরা যখন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন তখন আমি খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, দাদি তাঁর পরের স্বামীর বাড়ি নাওডোবা এলাকায় এখনো বেঁচে আছেন। তাই তাঁকে আমাদের বাড়িতে আনার পর আমার হারিয়ে যাওয়া ফুফু এলিজাবেথ ফিরোজা আসেন। এত বছর পর মা ও মেয়ের দেখা যখন হলো, তখন তাঁরা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন। আমাদের চোখেও তখন পানি আসে। তবে খুবই ভালো লাগছে।’
ফিরোজা বেগম বলেন, ‘পাঁচ মাসের গর্ভবতী থাকাকালে মৌসুমীর বাবা মারা যান। তখন অসহায় পয়ে পড়ি। কোনো রকমে চলছিল জীবন। তারই মধ্যে মৌসুমীর জন্ম হয় এক ননদের বাসায়। কিন্তু নিজেরই যেখানে খাবার জোগাতে হিমশিম খাই, সেখানে নবজাতকের ভরণপোষণ করাটা ছিল আমার জন্য খুবই কষ্টসাধ্য। আত্মীয়-স্বজন অনেকের বাড়ি বাড়ি ঘুরেছি। কোনো কূলকিনারা পাইনি। কিন্তু কোলের মানিক রাস্তায় ফেলে আসিনি। এক প্রতিবেশীর পরামর্শে শিশু মৌসুমীকে সরকারি শিশু সদনে রেখে আসি। সেই কোলের মানিক ৫০ বছর পর আবার আমার কোলে ফিরে আসবে, এটা আমি ভাবিনি। আল্লাহর কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া।’
এলিজাবেথ ফিরোজা বলেন, ছোটবেলা থেকে নরওয়েতে বড় হয়েছি। নরওয়ের মা-বাবা নাম রাখেন এলিজাবেথ। বড় হয়ে জানতে পারি আমার জন্ম বাংলাদেশে। মায়ের নাম ফিরোজা বেগম। তারপর থেকেই আমি ফিরাজা নামটাকে আমার নামের সঙ্গে যুক্ত করি। বিয়ের পর ২২ বছর বয়সে প্রথম সন্তান প্রসবের পর নরওয়ের চিকিৎসক আমার হিস্ট্রি জানতে চান। তখন থেকেই আমি আমার পরিবারকে খুঁজতে চেষ্টা করি। এ ব্যাপারে আমার স্বামী হ্যানরি ও সন্তানরা আমাকে অনেক সাহায্য করেছে। সেখানে আমার তিন ছেলে ও এক মেয়ে এবং নাতি-নাতনিও রয়েছে।’