বুড়িকিয়ারি বাঁধের কারণে হাকালুকি হাওর তীরের ৩ উপজেলায় দীর্ঘ জলাবদ্ধতা

10

নাজমুল ইসলাম, কুলাউড়া: ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার বুড়িকিয়ারি বাঁধের কারণেই হাকালুকি হাওর তীরের তিন উপজেলায় দীর্ঘ জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। এক সময় বন্যা হলেও সর্বোচ্চ সপ্তাহ-দশদিন থেকে দ্রুত পানি চলে যেতো। কিন্তু ২০১০ সাল থেকে এশিয়ার বৃহত্তম হাওর হাকালুকি তীরের ৩ উপজেলা কুলাউড়া,জুড়ী ও বড়লেখার বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে। সেই সময়ে দীর্ঘস্থায়ী ও ভয়াবহ বন্যার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় হাকালুকি হাওরের সাথে কুশিয়ারা নদীর সংযোগস্থলে অপরিকল্পিত বুড়িকিয়ারি সেই বাঁধ। শুধু বাঁধই নয় নদীর পাশে সেখানে গড়ে উঠা ইটভাটাও এজন্য দায়ী। সেই বুড়িকিয়ারি বাঁধ অপসারণের দাবিতে জাতীয় সংসদে বিষয়টি উত্থাপনসহ অনেক আন্দোলন হয়। কিন্তু দেড় দশকেও সেই বুড়িকিয়ারী বাঁধ অপসারণ হয়নি। ফলে গত ১৪ বছরে ৫বার হাওর তীরের মানুষকে ভয়াবহ ও দীর্ঘস্থায়ী বন্যার কবলে পড়তে হয়েছে। জানা যায়, সিলেট জেলার ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলায় ২০০৪ সালে উপজেলা পরিষদ ও পিটাই টিকর গ্রাম রক্ষার নামে কুশিয়ারা নদীর সাথে হাকালুকি হাওরের সংযোগস্থলে বুড়িকিয়ারী নামক স্থানে একটি অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ করে পানিউন্নয়ন বোর্ড। মূলত এর পর থেকে ২০১০, ২০১৪, ২০২০, ২০২২ ও ২০২৪ (চলতি) বন্যা দীর্ঘস্থায়ী ও ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। হাওর তীরের মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া, জুড়ী ও বড়লেখা উপজেলার প্রায় ১২ লক্ষাধিক মানুষ চরম দুর্ভোগের শিকার হয়।

২০১০ সালে যখন প্রথম দূর্ভোগের শিকার হন হাওর তীরের মানুষ, তখন প্রতিবাদে বিক্ষোভে ফেটে পড়েন তারা। হাওর তীরের মানুষ বন্যার দূর্ভোগ উপেক্ষা করে তখন (হাওর বাঁচাও কৃষক বাঁচাও) স্লোগান তুলে নানা আন্দোলন চালিয়ে গেছে। তৎকালীণ জাতীয় সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট নওয়াব আলী আব্বাছ খান বুড়ি কিয়ারি বাঁধ সরজমিন পরিদর্শণ করে বিষয়টি জাতীয় সংসদে উত্থাপন করেন। এরপর টনক নড়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের। সংসদীয় কমিটি ও পানি উন্নয়ন বোর্ড সরেজমিন পরিদর্শণ করেন বুড়িকিয়ারি বাঁধ। কুশিয়ারা নদী খনন করা সহ বুড়িকিয়ারি বাঁধ অপসারণের ঘোষণা দেয়া হয়। হাওর তীরের মানুষ আশায় বুক বাঁধে। কিন্তু তাদের সেই আশা হতাশায়রূপ নেয়। ধামাচাপা পড়ে যায় কুশিয়ারা নদী খননের কাজ। হাওরের সাথে কুশিয়ারার সংযোগস্থল টাই খনন হয়নি আজো। ফলে যেই দূর্ভোগ ছিলো সেই দূর্ভোগ থেকেই যায়। ইতি মধ্যে পেরিয়ে গেছে ১৪ বছর। ২০২২ এবং চলতি জুন মাসের বন্যায় সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে এই বন্যা ভয়াবহ রূপ ধারণ করে দীর্ঘ জলাবদ্ধতায় রুপ নেয়।

যার কারনে হাকালুকি হাওর তীরের মানুষ বুড়ি কিয়ারি বাঁধ অপসারনের দাবীতে ফের আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এদিকে সাম্প্রতি কুলাউড়া পৌরসভার মেয়র অধ্যক্ষ সিপার উদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল বুড়ি কিয়ারি বাঁধ পরিদর্শণ করেন। এরপর গত ১৭ জুলাই পৌরসভার আয়োজনে কুলাউড়া-জুড়ী ও বড়লেখা তিন উপজেলায় দীর্ঘস্থায়ী বন্যা ও জলাবদ্ধতা নিরসনে করণীয় বিষয়ক সভা অনুষ্ঠিত হয়, এতে তিন উপজেলার চেয়ারম্যান,মেয়র,ইউপি চেয়ারম্যান সহ রাজনৈতিক এবং সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।

কুলাউড়া পৌর মেয়র অধ্যক্ষ সিপার উদ্দিন আহমদ বলেন, এই বাঁধটি অপসারণ ও সংযোগস্থলকে প্রসারিত ও গভীর করে খনন করলে দীর্ঘ জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হতোনা। তিন উপজেলার নেতৃবৃন্দদের নিয়ে বুড়ি কিয়ারি বাঁধ অপসারনের জন্য সরকারের শীর্ষমহলের নজরে আনতে উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। যদি দাবী না মানা হয় তাহলে গণআন্দোলন গড়ে তুলা হবে।

বড়লেখা পৌরসভার মেয়র আবলু ইমাম মোঃ কামরান চৌধুরী বলেন, তিন উপজেলার জলাবদ্ধতা নিরসনে আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ আছি। দাবী আদায় না হলে আমরা পরবর্তী পদক্ষেপ নেবো।

জুড়ী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কিশোর রায় চৌধুরী মনি বলেন, অপরিকল্পিত বুড়ি কিয়ারি সেই বাঁধের কারনে মাসখানেক থেকে পানি বন্দি উপজেলা পরিষদ সহ বেশ কয়েকটি ইউনিয়ন। একসময় বন্যা হলেও পানি দ্রুত চলে যেতো। কিন্তু সেই বাঁধের কারনেই এখন দীর্ঘ জলাবদ্ধতা। আমরা এই বাঁধ অপসারনে দাবীতে ঐক্যবদ্ধ আছি।

মৌলভীবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ জাবেদ ইকবাল মুঠো ফোনে বলেন, বুড়ি কিয়ারি বাঁধের বিষয়ে আমরা অবগত আছি। বিষয়টি নিয়ে ডিসি এবং বিভাগীয় কমিশনারকে জানানো হয়েছে।

সিলেট বিভাগীয় পানি উন্নয়ন বোর্ডের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী খুশি মোহন সরকার মুঠো ফোনে জানান, তিনি সরেজমিন বুড়ি কিয়ারি বাঁধ পরিদর্শন করেছেন। বাঁধের বিষয় নিয়ে যে আলোচনা চলছে সেটা মূলত ফেঞ্চুগঞ্জ বাজার রক্ষার জন্য দেওয়া হয়েছিলো। বাঁধ নির্মাণ হলেও হাকালুকি হাওর ও জুড়ী নদীর পানি কুশিয়ারা নদীতে যাওয়ার জন্য খনন করে বিকল্প পথ তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে নদীতে পানি বেশি তাই পানি নিষ্কাশন হতে বিলম্ব হচ্ছে।