রাষ্টপতির পদত্যাগ দাবিতে সমাবেশ, রাতে ব্যারিকেড টপকে বঙ্গভবনে প্রবেশের চেষ্টা: বঙ্গভবন ঘিরে দিনভর উত্তেজনা

12

সবুজ সিলেট ডেস্ক 

রাষ্ট্রপতির পদ থেকে মো. সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগের জন্য ২৪ ঘণ্টা সময় বেঁধে দিয়েছে শিক্ষার্থীদের কয়েকটি সংগঠন। ওই সময়ের মধ্যে রাষ্ট্রপতির পদ না ছাড়লে ‘দুর্বার আন্দোলন’ গড়ে তোলার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। এ নিয়ে সোমবার রাত টিএসসিতে শুরু হওয়া আন্দোলন গড়ায় বঙ্গভবন পর্যন্ত। বঙ্গভবন ঘিরে মঙ্গলবার দিনভর ছিল উত্তেজনা। রাত পৌনে নয়টার দিকে বঙ্গভবনের সামনে পুলিশের ওপর চড়াও হয় আন্দোলনকারীরা। ব্যারিকেড ভেঙে বঙ্গভবনে ঢোকার চেষ্টা করে তারা। ওই সময় সেনাবাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য সেখানে উপস্থিত ছিলেন।

বিভিন্ন স্লোগানে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ দাবি করছিলেন আন্দোলনকারীরা। তারা বলেন, রাষ্ট্রপতি বঙ্গভবনে বসে ষড়যন্ত্র করছেন। তিনি শেখ হাসিনার পদত্যাগ পত্র নাকি খুঁজেন পান না। যিনি একটি পদত্যাগপত্র সংরক্ষণ করতে পারেন না তিনি দেশকে সংরক্ষণ করতে পারবেন না। তাই আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তার পদত্যাগের দাবি জানাচ্ছি। আমরা জানি কীভাবে দাবি আদায় করতে হয়। প্রয়োজন হলে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম ১২ ঘণ্টাতে নিয়ে আসব।

এর আগে, বঙ্গভবন ঘেরাও কর্মসূচি থেকে রাষ্ট্রপতিকে পদত্যাগের জন্য ২৪ ঘণ্টা সময় বেঁধে দেয় শিক্ষার্থীদের কয়েকটি সংগঠন। রক্তিম জুলাই ২৪, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা কমিটি, বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা, ইনকিলাব মঞ্চসহ বিভিন্ন ব্যানারে গতকাল মঙ্গলবার দুপুর থেকে শিক্ষার্থী ও জনতা খণ্ডখণ্ড মিছিল নিয়ে রাজউকের সামনের মোড়ে অবস্থান নেয়। পরে বিকাল সাড়ে ৪টায় বঙ্গভবনের সামনের থেকে ছাত্র-জনতার পক্ষে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে রাষ্ট্রপতিকে পদত্যাগ করার আহ্বান জানিয়ে বক্তব্য দেন এমদাদ বাবু।

রাষ্ট্রপতিকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতি পদে থেকে আপনি মিথ্যাচার করেছেন। আপনি খুনি শেখ হাসিনার দোসর। আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আপনার পদত্যাগ দাবি করছি। অন্যথায় আন্দোলন চলবে। আগামীকাল সকালে এসে যেন আমরা শুনতে পাই আপনি পদত্যাগ করেছেন। আপনার লজ্জা থাকলে আপনি পদত্যাগ করবেন।

এমদাদ বাবু বলেন, আমরা পরীক্ষিত সৈনিক, সম্মুখ যোদ্ধা। আমরা সংগ্রাম করতে গিয়ে হাত-পা-চোখ হারিয়েছি। যদি আরেকটা হাত পা চোখ দিতে হয় আমরা তাও দিতে প্রস্তুত আছি। রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের পাশাপাশি সংবিধান বাতিল, বিপ্লবী জাতীয় সরকার গঠন, আওয়ামী লীগসহ ১৪ দলকে নিষিদ্ধ করারও দাবি জানানো হয় সমাবেশ থেকে। এদিকে এ কর্মসূচির কারণে বঙ্গভবন এলাকা জুড়ে কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পুলিশের পাশাপাশি সেনাবাহিনীর সদস্যদেরও দেখা যায় সেখানে।

বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে সড়কের পাশের রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্লোগান দেয় বিক্ষোভকারীরা। তাদের দাবি, রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন শপথ ভঙ্গ করেছেন। এখন তিনি রাষ্ট্রপতির পদে থাকার যোগ্যতা হারিয়েছেন।

এ সময় ড. ইউনূসকে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিয়ে বিপ্লবী সরকার ঘোষণা করার দাবি জানানো হয়। ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদি বলেন, দেশের মানুষ এখন আপনার (রাষ্ট্রপতি) পদত্যাগ চায়। ফ্যাসিস্টদের পুনর্বাসন এ দেশের মাটিতে আর হতে দেব না। তিনি যদি নিজ থেকে পদত্যাগ না করেন তাহলে আমরা তাকে টেনে পদ থেকে নামাব।

পাঁচ দফা দাবিতে আল্টিমেটাম :
একই দাবিতে আল্টিমেটাম দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ, সংবিধান সংশোধন, বিগত তিনটি সংসদ নির্বাচন অবৈধ ঘোষণা করে নির্বাচিতদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করতে হবে, তারা যেন কখনো বাংলাদেশে নির্বাচন করতে না পারে সেজন্য আইনি ব্যবস্থা নেয়া, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ এবং এই সপ্তাহের মধ্যে জুলাই বিপ্লবকে ‘প্রোক্লেমেশন অব রিপাবলিক’ ঘোষণা- মোট পাঁচ দফা নতুন দাবি ঘোষণা করেছে ছাত্র আন্দোলন।

মঙ্গলবার বিকাল সোয়া ৫টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাদদেশে এই কর্মসূচি ঘোষণা করেন ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ। একইসঙ্গে অবিলম্বে এসব দাবি মেনে নেয়া না হলে শিগগিরই রাজপথে কঠোর কর্মসূচি দেয়া হবে বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তিনি। হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, যে শহীদ মিনার থেকে আমরা এক দফা দাবি তুলেছিলাম। সেই শহীদ মিনার থেকে আমরা পাঁচ দফা ঘোষণা দিচ্ছি। এই সপ্তাহের মধ্যে আমাদের পাঁচ দফা দাবি না মানা হলে আমরা আবার রাজপথে নেমে যাব।

কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসউদ বলেন, আগামী বৃহস্পতিবারের (৪৮ ঘণ্টা) মধ্যে ছাত্রলীগকে সন্ত্রাসী সংগঠনকে নিষিদ্ধ করতে হবে। যে ছাত্রলীগের হাতে মানুষের মৃত্যু হয়েছে তাদের রাজনীতি করার কোনো অধিকার নেই।

রাষ্ট্রপতিকে উদ্দেশ করে মাসউদ বলেন, আমরা এই শহীদ মিনার থেকে আমাদের বিপ্লব শুরু করেছিলাম। সেই বিপ্লবের ভয়ে বাংলাদেশ থেকে পালিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। আর এখন আপনি রাষ্ট্রপতি হিসেবে জনতার সঙ্গে প্রতারণা করছেন। শেখ হাসিনা যেভাবে পালিয়েছেন, চুপ্পুকেও পালাতে হবে। দেশের প্রশ্নে-দশের প্রশ্নে বিপ্লবীরা সব সময় মাঠে আছে।

সারজিস আলম বলেন, আবারো যদি প্রয়োজন হয় আমরা আমাদের চোখ দিতে প্রস্তুত, পা দিতে প্রস্তুত, হাত দিতে প্রস্তুত, এমনকি জীবন দিতেও প্রস্তুত আছি। ছাত্রলীগ যেভাবে আমাদের ভাইদের হত্যা করেছে, তাদের উত্থান সহ্য করা হবে না।

এ সমাবেশে আরো বক্তব্য রাখেন ছাত্র আন্দোলনের নুসরাত তাবাসসুম, আব্দুল হান্নান, আবু বাকের মজুমদার, রিফাত রশীদ প্রমুখ।
বৈষম্যবিরোধী চিকিৎসক ও স্টুডেন্ট পরিষদ, জাতীয় নাগরিক কমিটি, ঢাকা মহানগর, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, মিরপুর লেখা সংবলিত ব্যানার নিয়ে শহীদ মিনারে সমবেত হন আন্দোলনকারীরা। তারা রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ চেয়ে বিভিন্ন স্লোগান দেন। সমাবেশ শেষে তারা বিকাল ৫টায় মিছিল নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ঘুরে রাজু ভাস্কর্যের সামনে যান তারা।

স্বারকের চার দফা : 
রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের অপসারণসহ চার দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ সমাবেশে আল্টিমেটাম দিয়েছে ‘স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা কমিটি (স্বারক)’ নামের একটি সংগঠন।

মঙ্গলবার দুপুরে ‘বঙ্গভবন ঘেরাও ও অবস্থান কর্মসূচি’ ব্যানারে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে তারা। ‘সার্বভৌমত্ব রক্ষা কমিটির’ চার দফা দাবির মধ্যে রয়েছে- রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ, সংবিধান বাতিল, বিপ্লবী জাতীয় সরকার গঠন এবং আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও ১৪ দলকে নিষিদ্ধ করা।

স্বারকের নাগরিক কমিটির সদস্য মোহাম্মদ রফিক খান বলেন, আমরা দীর্ঘ একটি সময় রক্তক্ষরণের মাধ্যমে আমাদের এই স্বাধীনতা অর্জন করেছি; এই স্বাধীনতা রক্ষা করতে আমরা এখনো রাজপথে আছি। স্বৈরাচার আমাদের এই স্বাধীনতাকে বিভিন্নভাবে কলুষিত করার জন্য পাঁয়তারা করে আমাদের অন্তর্বর্তী সরকারকে বিব্রত করছে। তারা একের পর এক অযৌক্তিক দাবি তুলে আমাদের এই রক্তে কেনা স্বাধীনতাকে কলঙ্কিত করছে। এসবের মূল ইন্ধনদাতা খুনি হাসিনার অবৈধ নিয়োগপ্রাপ্ত বর্তমান রাষ্ট্রপতি; যে কিনা আমাদের রক্তের উপর বসে এখনো হোলি খেলছে। আমরা এটা আর হতে দিতে পারি না।

প্রসঙ্গত. গত ৫ আগস্ট ছাত্র আন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত চলে যান। সেদিন রাতে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা হয়েছে। সম্প্রতি মানবজমিন পত্রিকার প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমানের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে রাষ্ট্রপতি জানান, তিনি শুনেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন, কিন্তু তার কাছে এ সংক্রান্ত কোনো দালিলিক প্রমাণ বা নথিপত্র নেই। রাষ্ট্রপতি বলেন, বহু চেষ্টা করেও আমি ব্যর্থ হয়েছি। তিনি হয়তো সময় পাননি।

রাষ্ট্রপতির ওই বক্তব্যের পর তার অপসারণ বা পদত্যাগের দাবি জোরালো হয়ে উঠে। রাষ্ট্রপতির পদত্যাদের দাবিতে আবারো মাঠে নামে তারা। রাষ্ট্রপতি ‘মিথ্যা বলে শপথ ভঙ্গ’ করেছেন মন্তব্য করে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, তাকে এখনো রাষ্ট্রপতি পদে রাখা যায় কিনা, উপদেষ্টা পরিষদ তা ভেবে দেখতে পারে। পরে বঙ্গভবন থেকে এক বিবৃতিতে বিষয়টি মীমাংসিত বলে বিভ্রান্ত না হওয়ার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।