নিজস্ব প্রতিবেদক
সিলেটসহ সারা দেশে সাত ধাপে ২০২২ সালে সম্পন্ন হয়েছিলো দশম ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন। স্থানীয় সরকারের সর্বনিম্ন এই প্রতিষ্ঠানেও দলীয় প্রতীকের মাধ্যমে নির্বাচন দিয়েছিলো গত ১৫ বছরের আওয়ামী লীগ সরকার। বিতর্কিত এই নির্বাচনে
সিলেট বিভাগের ৩৩৬টি ইউনিয়নে বেশিরভাগ নৌকার প্রার্থীই বিজয়ী হন। কিন্তু ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের কারণে আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান লাপাত্তা হয়ে যান। কিছুদিন পর ফিরে আসেন কিছুসংখ্যক চেয়ারম্যান।
কিন্তু তারা ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় নাশকতার ঘটনাগুলোতে দায়েরকৃত মামলায় আসামি হওয়ায় একের পর এক হচ্ছেন গ্রেফতার। আওয়ামীপন্থী এসব চেয়ারম্যান গ্রেফতার হওয়ায় এবং পলাতক থাকায় জনগণ পড়েছেন বেশ ভোগান্তিতে। ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে গিয়ে ঠিকমতো পাওয়া যাচ্ছে না এসব চেয়ারম্যানকে, ফলে কাঙ্ক্ষিত সেবা পাচ্ছেন না সাধারণ মানুষ।
এছাড়া আওয়ামীপন্থী অনেক ওয়ার্ড মেম্বারও পলাতক রয়েছেন গ্রেফতার আতঙ্কে বা হামলা হওয়ার আশঙ্কায়।
জানা গেছে, সিলেট বিভাগের ৪ জেলায় ৩৩৬টি ইউনিয়ন রয়েছে। এর মধ্যে সিলেট জেলায় রয়েছে ১০৬টি ইউনিয়ন। দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠিত দশম ইউপি নির্বাচনে বেশিরভাগ পরিষদে নির্বাচিত হন নৌকা কিংবা আওয়ামী লীগেরই বিদ্রোহী প্রার্থী। ওয়ার্ড সদস্য পদেও নির্বাচিত হন বেশিরভাগ আওয়ামীপন্থী প্রার্থী। কিন্তু ৫ আগস্টের পর তারা সবাই লাপাত্তা হয়ে যান।
স্থানীয় সরকার বিভাগ সিলেট জেলা কার্যালয় সূত্র বলে- জেলায় ১৩টি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অনুপস্থিত রয়েছেন। এর মধ্যে মাত্র একজন ইউপি চেয়ারম্যান গ্রেফতার হওয়ার খবর রয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগের কাছে।
কিন্তু দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র বলছে- এখন পর্যন্ত সিলেট বিভাগে ৯ জন আওয়ামীপন্থী ইউপি চেয়ারম্যান গ্রেফতার হয়েছেন। এর মধ্যে জেলায় ৫ জন গ্রেফতার হয়েছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে। তারা হলেন- দক্ষিণ সুরমা উপজেলার মোগলাবাজার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম সাইস্তা, গোলাপগঞ্জ উপজেলার লক্ষ্মীপাশা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়্যারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা মাহতাব উদ্দিন জেবুল, বিয়ানীবাজারের চারখাই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য হোসেন মুরাদ চৌধুরী, গোয়াইনঘাট উপজেলার ডৌবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের কৃষিবিষয়ক সম্পাদক এম নিজাম উদ্দিন এবং বিশ্বনাথ উপজেলার দেওকলস ইউপি চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহ-সভাপতি ফখরুল ইসলাম মতছিন।
সূত্র বলছে- জেলার অন্তত অর্ধেক ইউনিয়ন পরিষদে দাপ্তরিক কাজ করেন না চেয়ারম্যানরা। তারা রয়েছেন পলাতক।
ভুক্তভোগী নাগরিকরা বলছেন- ইউপি চেয়ারম্যানরা বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, মাতৃত্বকালীন ভাতা বিতরণের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। ওয়ারিশ সনদ, চারিত্রিক সনদ, জন্ম-নিবন্ধন, মৃত্যু-নিবন্ধনের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো ইউনিয়ন পরিষদ থেকে হয়ে থাকে, উপস্থিত থাকতে হয় চেয়ারম্যানদের। এছাড়া গ্রাম্য বিভিন্ন সালিস, নতুন রাস্তা নির্মাণ, পুরোনো রাস্তা সংস্কার এবং পর্যবেক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণ ইউনিয়ন পরিষদ থেকে হয়ে থাকে। কিন্তু চেয়ারম্যানরা পালিয়ে থাকায় বর্তমানে এসব সেবা প্রদানে চরমভাবে বিঘ্ন ঘটছে।
স্থানীয় সরকার বিভাগের সিলেট জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক সুবর্ণা সরকার বৃহস্পতিবার (৩১ অক্টোবর) সিলেটভিউ-কে বলেন- আমরা গত মাসে তালিকা করেছিলাম। এই তালিকা অনুযায়ী সিলেট জেলার ১৩টি ইউনিয়নে চেয়ারম্যান অনুপস্থিত। এর মধ্যে দুজন ছুটি নিয়েছিলেন অফিসিয়ালি, বাকিরা কিছু না জানিয়েই অফিস করছেন না। আর এখন পর্যন্ত লক্ষ্মীপাশা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়্যারম্যানের গ্রেফতারের বিষয়টি আমরা অবগত আছি।
এক প্রশ্নের উত্তরে সুবর্ণা সরকার বলেন, স্থানীয় সরকার বিভাগের আইন অনুযায়ী কোনো ইউপি চেয়ারম্যান এক সপ্তাহের বেশি ছুটি নিতে পারেন না। এর বেশি দপ্তরে অনুপস্থিত থাকলে উপজেলা প্রশাসনকে অবগত করে পরিষদের মতামতের ভিত্তিতে ১নং প্যানেল চেয়ারম্যান দায়িত্ব পালন করবেন। আর কোনো চেয়ারম্যান গ্রেফতার হলে তার ওয়ারেন্টসহ মামলার কাগজপত্র স্থানীয় সরকার বিভাগের এসে পৌঁছলে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। পরবর্তীতে আদালতের রায়ে অপরাধী সাব্যস্ত হলে গ্রহণ করা হয় আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা।
এদিকে, মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল একটি সূত্র সর্বশেষ জানিয়েছে- জনপ্রতিনিধি না থাকায় সেবাপ্রার্থী মানুষের দুর্ভোগ কমাতে ইতোমধ্যে দেশের ৩৬৩টি ইউনিয়ন পরিষদে প্রশাসক নিয়োগ দিয়েছে সরকার। আর ১ হাজার ৫৩টি ইউনিয়ন পরিষদে প্যানেল চেয়ারম্যানদের দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর দেশের ১ হাজার ৪১৬টি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও মেম্বার (সদস্য) গা ঢাকা দিয়েছেন। তারা সবাই আওয়ামী লীগ সমর্থিত বা এ দলের নেতা কিংবা কর্মী।
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ সর্বশেষ এ বিষয়ে বলেন, ‘রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর জনপ্রতিনিধিরা নিরুদ্দেশ হয়েছেন। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বাররাও গা ঢাকা দিয়েছেন। যেখানে ১০ থেকে ১২ জন থাকার কথা, সেখানে হয়তো দু-তিনজন আছেন। এতে জনগণ সেবা বঞ্চিত হচ্ছে। আমরা এ বিষয়ে কাজ করছি। শিগগিরই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে- ইউনিয়ন পরিষদের জনপ্রতিনিধিদের অনুপস্থিতির হার কম হলে প্রশাসক নিয়োগ না করে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়ার পরিকল্পনা ছিল। তবে ডিসিদের পাঠানো তথ্যে দেখা গেছে, এই সংখ্যা মোটেও কম নয়। প্রায় দেড় হাজার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অফিস করছেন না। আবার এত ইউনিয়ন পরিষদে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়ার মতো কর্মকর্তাও নেই। ফলে যেসব ইউনিয়নে চেয়ারম্যান অনুপস্থিত, কিন্তু বেশিরভাগ মেম্বার উপস্থিত সেখানে প্যানেল চেয়ারম্যান গঠন করে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আর যেসব ইউনিয়নে চেয়ারম্যানের পাশাপাশি বেশির ভাগ মেম্বারও অনুপস্থিত সেখানে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।