স্টাফ রিপোর্ট
টিলা ও পাহাড় প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। তবে এক শ্রেণির অসাধু ভূমিদস্যুরা নিজেদের ব্যক্তি স্বার্থে পাহাড়-টিলা কেটে সাবাড় করছে। কোন কিছুতেই যেন পাহাড়-টিলা কাটা থামানো যাচ্ছে না। পাহাড় কাটা বন্ধ তো দূরের কথা দিন দিন পাহাড়-টিলা কেটে সাভাড় করায় প্রাকৃতিক ভারসাম্য পড়েছে হুমকির মুখে।
সিলেটের বিভিন্ন জায়াগায় থাকা এসব টিলা ও পাহাড় গুলোর প্রতি রয়েছে ভূমি খোকোদের কু-নজর। দিন ও রাতের বেলায় প্রকাশ্যে টিলা কাটলেও সংবাদপত্র সংবাদ প্রকাশের পর দায়সারা শাস্তির কারণে টিলা খোকোরা আরো উৎসাহ পাচ্ছে। দিনের পর দিন পাহাড় কেটে প্রকৃতিকে ধ্বংস করলেও পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা রয়েছেন অন্ধকারে। মাঝে মাঝে উপজেলা প্রশাসনের অভিযানে বন্ধ থাকলেও কয়েকদিন পর আবারো চলে টিলাকাটার মহোৎসব। নিজস্ব ফায়দা লুটতে পাহাড়ের মাটি কেটে বিক্রি, আবাস্থল গড়ে তোলাসহ নানা স্বার্থে এসব পাহাড়গুলোকে নির্বিচারে বিলীন করে দিচ্ছে।
অথচ ১৯৯৫ সালের বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের এর ৬ (খ) ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সরকারি বা আধা সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন বা দখলাধীন বা ব্যক্তিমালিকানাধীন পাহাড় ও টিলা কর্তন বা মোচন করতে পারবে না। তবে অপরিহার্য জাতীয় স্বার্থের প্রয়োজনে অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নিয়ে পাহাড় বা টিলা কাটা যেতে পারে।
প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিতে টিলা খেকোরা এখন টিলা কাটায় তাদের কৌশল পাল্টাচ্ছে। দিনের বেলা টিলা কম কাটলেও রাতকে বেছে নিয়েছে টিলাকাটার মুখ্য সময় হিসেবে। বেশিরভাগ সময়ে নিঝুম রাতে চলে চা-বাগান ও বনানঞ্চলে আবৃতে ঘেরা টিলা কাটার ধুম। বিগত কয়েক বছরে এ অঞ্চলের প্রায় অর্ধেকের চেয়ে বেশি পাহাড় ও টিলা কেটে সমতল করা হয়েছে। এ নিয়ে স্থানীয় লোকজনের মাঝে চাপা ক্ষোভ থাকলেও প্রভাবশালীদের ভয়ে কেউ মুখ খুলতেও পারছেন না। প্রভাবশালী মহলটি ক্ষমতার দাপট ও প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে রাতের আধাঁরে পাহাড়ের মাটি কেটে সাবাড় করে ফেলছে। ফলে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য হুমকি মুখে পড়েছে।
সরেজমিন সিলেটের নগরীর বিভিন্ন এলাকাঘুরে দেখা যায় ঘুরে দেখা যায়, চা-বাগানের উঁচু টিলার মাঝখানে মাটি কেটে করা হয়েছে সমতল। পাশেই হারানো পাহাড়ের ক্ষত চিহ্ন। কোথাও কোথাও পাহাড়ের বুক চিরে সমতল করা জায়গায় স্থানীয় এক শ্রেণির বাসিন্দারা ঘর নির্মাণের কাজে ব্যস্ত। যেন পাহাড়-টিলা কাটার উৎসবে নেমেছে তারা। সে সঙ্গে পাহাড়-টিলার চূড়ায় থাকা বিভিন্ন প্রজাতির গাছ নিধন করে ফেলছে। প্রকৃতির বুকে মানুষের এমন আচরণের কারণে জীববৈচিত্র্য এখন হুমকির মুখে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, টিলার মাটি কাটার কাজে অনেক সময় অধ্যাধুনিক ভেকু মেশিন ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে বেশির ভাগ সময়ে শ্রমিকদের মাধ্যমে কোদাল দিয়ে টিলার মাটি কেটে সেগুলোকে ট্রাক্টরে করে বিভিন্ন স্থানে নিয়ে বিক্রি হচ্ছে। আবার অনেকেই গর্ত বা জমি ভরাট করে ঘর বাড়ি নির্মাণ করছে। তবে টিলা কেটে প্রকাশ্যে পরিবহন দিয়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে গেলও কারো যেন এসব চোখে পড়ছে না।
আলাপকালে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিলেট নগরীর ৮নং ওয়ার্ডের এক বাসিন্দা জানান, যেভাবে প্রভাবশালীরা নির্বিচারে ও অপরিকল্পিতভাবে পাহাড় কাটছে তাতে করে তা জনজীবনের জন্য হুমকি স্বরূপ। পাহাড়ের তলে কিংবা পাহাড়ে যেসব বাড়িঘর রয়েছে ভারী বর্ষণে যেকোনো মুহূর্তে ধসে গিয়ে প্রাণহানি হবে এবং পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। তারা আরো বলেন, প্রশাসন টিলা কাটার বিরুদ্ধে কখনও কখনও ব্যবস্থা গ্রহণ করলেও আবার থমকে যায়। প্রভাবশালীসহ অনেক জনপ্রতিনিধি দিন দিন টিলা কেটে পাহাড়ি জনপদগুলো নষ্ট করে দিচ্ছে। পাহাড় রক্ষায় প্রশাসনকে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে।
সরেজমিনে বৃহস্পতিবার (৩১ অক্টোবর) সকালে নগরীর ৮নং ওয়ার্ডের ব্রাহ্মনশান মৌজা এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, টিলা কেটে ঘর নির্মাণ করেছেন রূপক দাস। রূপক দাস টিলা কাটেন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা সাবেক কাউন্সিলর জগদিশ চন্দ্র দাসের ভাতিজা বিনয় চন্দ্র দাসের নেতৃত্বে। বিনয় চন্দ্র দাস সিলেট সিটি করপোরেশনে কাজ করেন। তবে চাচা জগদিশ চন্দ্র দাস ৫ আগস্টের পর আত্মগোপনে চলে গেলে চাচার রেখে যাওয়া টিলা কেটে জায়াগা ও প্লট নির্মাণের ব্যবসা তিনি ধরে রেখেছেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয় এলাকাবাসী।
হাওলাদাপাড়া, জালালিয়া, দুস্কি, করেরপাড়া, তারাপুর চা-বাগান, মজুমদার টিলায় টিরা কেটে অবৈধ প্লট বিক্রি, দোকান নির্মাণ করে যাচ্ছেন। তার সাথে যুক্ত রয়েছেন বিনয় দাস, রূপক দাস, চন্দন দাস, এরশাদ আহমদ।
টিলা কাটানোর ব্যাপারে জানতে চাইলে এলাকাবাসী বলেন, ৮নং ওয়ার্ডের বিভিন্ন স্থানে ২৫ বছর ধরে সাবেক কাউন্সিলর জগদিশ চন্দ্র দাস টিলা কেটে আসছেন। এখন ৫ আগস্টের পর তার দ্বায়িত্ব নিয়েছেন তার ভাতিজা বিনয় চন্দ্র দাস।
টিলা কাটার ব্যাপারে জানতে চাইলে রূপক দাস বলেন, আমি এসব বিষযে কিছু জানি নাহ। তবে টিলাকটার দায়ে পরিবেশ অধিদপ্তর আমার নামে মামলা করেছে।
এ ব্যাপারে বিনয় চন্দ্র দাসের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ কারার চেষ্ঠা করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
এ ব্যাপারে জগদিশ চন্দ্র চন্দ্র দাসের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ কারার চেষ্ঠা করা হলে তিনওে ফোন রিসিভ করেননি।
এদিকে ২৯ অক্টোবর ৮নং ওয়ার্ডভূক্ত ব্রাহ্মণশাসন মৌজায় টিলা কেটে স্থাপনা নির্মাণ করার অভিযোগে এক অভিযান পরিচালনা করে পরিবেশ অধিদপ্তর সিলেট। অভিযানে সহকারী কমিশনার (ভূমি), মহানগর সার্কেল মাহমুদ আশিক কবির নেতৃত্ব দেন। অভিযানে রূপক দাস টিলা কেটে ঘর নির্মাণ করায় তার বিরুদ্ধে ভ্রাম্যামণ আদালত পরিচালনা করা হয়। এসময় পরিবেশ অধিদপ্তর, সিলেট জেলার কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. বদরুল হুদা মোবাইল কোর্টে প্রসিকিউশন প্রদান করেন। মোবাইল কোর্টের উপস্থিতি টের পেয়ে অন্যান্য অভিযুক্ত ব্যক্তিরা পালিয়ে যায়। এসময় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বিবাদীর বিরুদ্ধে তদন্তপুর্বক নিয়মিত মামলা রুজুর আদেশ প্রদান করেন।