নিজস্ব প্রতিবেদক
সিলেটে এবার ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের কথিত দোসর সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (সিমেবি) উপাচার্য (ভিসি) অধ্যাপক ডা. এ এইচ এম এনায়েত হোসেনকে স্বপদে রাখতে তৎপর হয়ে উঠেছে বিএনপির কতিপয় নেতা। তাদের মদদ ও আশ্বাসে শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর আত্মগোপনে থাকা এই ভিসি প্রায় আড়াই মাস পর পুলিশ নিয়ে বৃহস্পতিবার (৭ নভেম্বর) নিজ কার্যালয়ে ফেরেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন সিলেট মহানগর বিএনপির সহসভাপতি ডা. নাজমুল ইসলামও। যাকে ২১ অক্টোবর ভিসি ডা. এনায়েত হোসেন অজানা স্থান থেকে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন হিসাবে নিয়োগ দেন। বিএনপি নেতাদের আশ্বাসে নিজ কার্যালয়ে ফিরে রোষানলে পড়েন ভিসি। তাকে অবরুদ্ধ করে রাখেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। খবর পেয়ে সেনাবাহিনী, পুলিশসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। এমতাবস্থায় বিএনপির তিন কেন্দ্রীয় নেতার ইশারায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে বৈঠক হয় ভিসির। বৈঠকে ভিসির পক্ষে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন বিএনপি নেতা ডা. নাজমুল ইসলাম। একপর্যায়ে ১৫ দিনের মধ্যে দাবি দাওয়া পূরণের আশ্বাস দিয়ে প্রায় সাড়ে তিন ঘন্টা পর তিনি মুক্ত হন ভিসি। এ ঘটনায় সিলেটে তোলপাড় চলছে। এহেন কর্মকাণ্ডে বিএনপি নেতাকর্মীরা ক্ষুব্ধ।
সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স ৬ বছর। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভিসি ছিলেন ডা. মোর্শেদ আহমদ চৌধুরী। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে নিয়োগ বাণিজ্যে অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে তাকে অপসারণ করা হয়। ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য ডা. এএইচএম এনায়েত হোসেনকে ভিসি হিসাবে নিয়োগ দেন। কিন্তু ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর থেকে তিনি লাপাত্তা ছিলেন।
বিভিন্নভাবে তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। কিন্তু তার পক্ষ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। এমনকি তিনি কারও সঙ্গে দেখাও করতেন না। এমন পরিস্থিতিতে বেতন-ভাতা ও দাপ্তরিক কাজ আটকে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে।
হঠাৎ বৃহস্পতিবার সকালে লাপাত্তা ভিসি নিজ কার্যালয়ে ফেরার খবর পেয়ে ক্যাম্পাসে জড়ো হন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। আন্দোলনকারীদের দাবি, বৃহস্পতিবার সকালে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা-কর্মীদের নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে গুরুত্বপূর্ণ নথি নিয়ে যাওয়ার খবর পেয়ে ক্যাম্পাসে অবস্থান নেন তারা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈষম্যবিরোধী কর্মকর্তা-কর্মচারী পরিষদের সভাপতি আব্দুস সামাদ চৌধুরী বলেন, ‘৫ আগস্টের পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক বলতে কেউ নেই। উপাচার্য, রেজিস্ট্রার ও কোষাধ্যক্ষ তিনজনই অনুপস্থিত। আজ যুবলীগ-ছাত্রলীগকে নিয়ে ভিসি ক্যাম্পাসে আসার খবর পেয়ে তারা অবস্থান নেন।’
সূত্র জানায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে না আসলেও সিলেট বিএনপির কেন্দ্রীয় তিন নেতার সঙ্গে ভিসি অধ্যাপক ডা. এ এইচ এম এনায়েত হোসেনের যোগাযোগ ছিল। তাদের পরামর্শেই ডিন হিসেবে নিয়োগ পাওয়া বিএনপি নেতা ডা. নাজমুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে ভিসি অধ্যাপক এনায়েত হোসেন বৃহস্পতিবার কার্যালয়ে আসেন।
এ বিষয়ে সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (সিমেবি) নতুন দায়িত্বপ্রাপ্ত ডিন ডা. মো. নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা স্বৈরাচারের দোসরদের সঙ্গে আপোষ করবো না। তারা আমাদের কাছে আশ্রয় পাবে না। আর উনাকে (ভিসি) টেক কেয়ার করা কিংবা সহযোগিতার প্রশ্নই আসে না।’
স্বৈরাচারের দোসর বললেও ভিসির সইয়ে ডিন পদে নিয়োগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০তম সিন্ডিকেটের সভায় আমাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তিনি সই করেছেন মাত্র। দেশের বৃহত্তম স্বার্থে এটা এমন কিছু না। কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাকে অবরুদ্ধ করে দাবি-দাওয়া জানিয়েছেন।’
বঙ্গমাতা শেখ ফজিলতুন্নেছা মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্যাডে নিয়োগ কার্যকর হলেও এ নাম তিনি সমর্থন করেন না জানিয়ে নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের আগের নামে ফিরে যাব। এই নাম মানি না, মানবো না।’
উল্লেখ, ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। পরবর্তীতে নাম পাল্টে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় নামকরণ করে আওয়ামী লীগ সরকার।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য ডা. মুর্শেদ আহমদ চৌধুরী ও রেজিস্ট্রার (অতিরিক্ত দায়িত্ব) নঈমুল হক চৌধুরী নিয়োগ বাণিজ্যসহ ব্যাপক জালিয়াতি করেন।
এসব অভিযোগের ভিত্তিতে মেয়াদ শেষ হলে প্রথমে চাকরি হারান রেজিস্ট্রার (অতিরিক্ত দায়িত্ব) নঈমুল হক চৌধুরী। এরপর একই পথে যেতে হয় উপাচার্য ডা. মোর্শেদ আহমদ চৌধুরীকেও।
প্রথম উপাচার্যের মেয়াদ শেষে ২০২৩ সালের শুরুতেই দ্বিতীয় উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান আওয়ামী লীগ সরকারের স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এ এইচ এম এনায়েত হোসেন।
ডা. এনায়েত হোসেন যোগ দেওয়ার আগেই আগের উপাচার্যের অস্থায়ীভাবে নিয়োগ দেওয়া সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন-ভাতা স্থগিত করার নির্দেশনা দেয় মন্ত্রণালয়। এরপর ২২ মাস পেরিয়ে গেলেও, কোনো বেতন-ভাতা পাননি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
নিয়োগের পর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা দূর করার আশ্বাস দেন ভিসি ডা. এনায়েত। কিন্তু দায়িত্ব গ্রহণের প্রায় দুই বছর হলেও এসবের কোনো কিছুই করেননি তিনি।
এই অবস্থায় সৃষ্ট জটিলতা ও বকেয়া বেতনের দাবিতে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্দোলন চলাকালেই গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। এরপর থেকে ভিসি, রেজিস্ট্রার ও কোষাধ্যক্ষ তিনজনই নিখোঁজ হয়ে যান। গত মাসে পদত্যাগ করেছেন রেজিস্ট্রার আবুল কালাম মো. ফজলুর রহমান। তার বিরুদ্ধেও ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে ভিসি ডা. এ এইচ এম এনায়েত হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টাও করা হয়। কিন্তু তাকে পাওয়া যায়নি।